A piece of abstract photo sunshine - বিমূর্ত ছবির এক টুকরো রোদ - (Part 11)
বিমূর্ত ছবি
ভোরের বাতাস গায়ে লাগে এখন ঠান্ডা হিমেল হওয়ার মত কানের দু'পাশে বয়ে যেতে থাকে সকালের রোদ উঁচু উঁচু দালানের ছাদ পেরিয়ে এখনও রাস্তায় এসে পৌঁছতে পারেনি। তবে কোথাও কোথাও দেওয়ালের পাশ ঘেষে টুকরো টুকরো হয়ে রাস্তার উপরে এসে পড়ছে। চালক রাস্তা ফাঁকা পেয়ে গতি একটু বাড়িয়ে দেয়।
সৌরভ একবার চালককে আস্তে চালাতে বলতে চায়, আবার থেমে যায়। আটটার আগে হলে পৌঁছতে না পারলে জমা দেওয়া নাও যেতে পারে। তাই আর কিছু বলে না। চালক ইচ্ছামত গতি বাড়িয়ে টেক্সি ভার্সিটির এক নম্বর গেইটে নিয়ে আসে । বাঁয়ে মোড় নিয়ে ভেতরে ঢুকে রেল লাইন ক্রস করতে মনে হয় ভার্সিটি এসে গিয়েছে। রাস্তার দু'পাশের সারি সারি গাছ পেছনে ফেলে ট্রেন স্টেশনের পাশ দিয়ে সৌরভ ভেতরে ঢুকে পড়ে । টিন শেডের রেল ষ্টেশনটির মতো তাদের অপেক্ষা যেন এখনও শেষ হয়নি। রাতের শিশির বিন্দু ভোরের রোদ মেখে দাড়িয়ে আছে।
কখন সকালের ফার্স্ট ট্রেন আসবে। টেক্সি শাহজালাল হলের গেটে এসে দাঁড়ায়। সৌরভ নেমে এদিক সেদিক না তাকিয়ে ঢাল বেয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে । হাতের বাম পাশের বাগানের দিকে না তাকিয়ে পারে না। আগের মত ফুলের মেলা এখন আর নেই। ছেঁড়া ছেঁড়া ফুল ফুটেছে। অনেক স্মৃতি ফুলের গাছে গাছে পাতায় পাতায় যেন এখনও জড়িয়ে আছে। এসব ভাবার সময় এখন নেই। সে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায়। হলের সামনে ঝর্ণা এখন আর কানায় কানায় পানি ভরে উঠে না।
সে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে অফিসের সামনে দাঁড়ায়। বাইরের টুলে বসা গার্ড পিয়ন কয়জন সৌরভকে এতদিন পরও চিনতে পারে। ওকে সামাল দিয়ে দাঁড়ায় সৌরভ নাম ভুলে গেলেও সৌজন্য দেখিয়ে জানতে চায় কেমন আছেন আপনারা। ওরা বলে, ভালো। এতদিন পরে স্যারের কি মনে পড়লো আমাদের। সার্টিফিকেটের জন্য এসেছি। পিয়ন আগ বাড়িয়ে বলে, বড়ুয়া বাবু এখন এসব দেখেন, উনি এসেছেন, ভেতরে আছেন। সৌরভ বড়ুয়ার কথা ঠিক মনে করতে পারলো না।
অনেকদিন পরও দোকানের চেহারা তেমন পাল্টায়নি। আগের মত প্লাষ্টিকের প্লেট, টিনের জগ, গ্লাস আর কমদামী চায়ের কাপ-পিরিচ এখনও রয়ে গেছে। সৌরভ কনডেন্স মিল্কের এক কাপ চা খায়। পুরানো স্বাদটা যেন আবার খুঁজে পায়। চা খাওয়ার পরও খানিক বসে থাকে। ছাত্র-ছাত্রীদের ফ্যাকালটিতে যাওয়ার দৃশ্যটা ভালো লাগছে। বিশেষ করে কোন কোন রিক্সায় তিনজন একসাথে বসে হাওয়া খেতে খেতে এগিয়ে যায়। ছেলে বা মেয়ে যেন কোন বিভেদ নেই। একই রিক্সায় হয়ত দুইজন মেয়ে মাঝে একটু উপরে একজন ছেলে দিব্যি বসে আছে।
কোন জড়তাই যেন তাদের স্পর্শ করতে পারছে না। সৌরভদের সময় এভাবে ছেলে মেয়েরা রিক্সায় শেয়ার করতো না। সেকেন্ড ট্রেন আসার পর নিঃশব্দতা ভেঙে যায়। ছাত্র-ছাত্রীর কোলাহলে মেতে উঠে স্টেশন থেকে আমানত হলের মোড় পর্যন্ত। দোকানের সামনে দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়া যায় না। গাড়িগুলি একের পর এক ফ্যাকালটির দিকে ছুটে চলে। তাড়াহুড়া করে যারা উঠতে পারে তারা আগে যেতে পারে। এসময়ে অনেকের এক কাপ চা না খেলে চলে না। সৌরভ এভাবে নিজের ভালো লাগার জন্য বসে থেকে একটা সিট দখল করে রাখা ঠিক হবে না ভেবে উঠে পড়ে।
রাস্তার পাশ দিয়ে উঁচু নিচু টিলার পথ ধরে ষ্টেশনের কাছে আসে। খানিক আগে যাওয়ার সময় ষ্টেশনের সামনের এ মাঠটি ফাঁকা ছিল। এখন যেন শরতের শিউলি বকুলের মেলা বসেছে। কিছুক্ষণ পর হয়ত বাতাসের সাথে উড়ে যাবে যেন। এখানে দাঁড়িয়ে থাকার মাঝে যে কত আনন্দ তা পড়ার সময় ভাবতে পারেনি। তখনও কেউ কেউ জুটি বাঁধতো, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আলাপ করতো। ষ্টেশনের বেঞ্চে ঘন্টর পর ঘন্টার পাশাপাশি বসে থাকতো।
ট্রেনের কম্পার্টমেন্টের কোণার সিটে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতো। এসব দৃশ্য কখনো তাকে তেমন আকর্ষণ করতে পারেনি। কেন যেন মনে হতো পড়তে এসে এসবে কেন জড়ানো। কিন্তু ক্লাসের একটি মেয়েকে ভালো লাগতো। কেমন যেন চুপচাপ স্বভাবের মেয়েটি অন্যদের চেয়ে কিছুটা আলাদা। শান্ত চেহারার মাঝে কোথায় যেন এক টুকরো দুঃখও লুকিয়ে আছে এমন মনে হতো। সে মেয়েটি অনার্স ফাইনাল দেওয়ার পর কোথায় উধাও হয়ে গেল কেউ বলতে পারলো না।
মাষ্টার্স ফাইনালে আবার কোথা থেকে এসে পরীক্ষাও দিলো। তখন কিন্তু মেয়েটির চেহারায় লুকিয়ে থাকা দুঃখটা আনন্দের ভেতর মিলিয়ে গিয়ে মেয়েটিকে খানিকটা অপরিচিত করে তুললো। পরে অবশ্য জানা গেল মেয়েটি বিয়ের পরপরই স্বামীর সাথে কানাডা চলে গিয়েছে।
মিনারের আশে পাশের এলাকাটি আগের মত নেই। ঝোপ-ঝাড় অনেক কমে গেছে, বিল্ডিং উঠেছে কয়েকটি নতুন ভবনও উঠছে একটি। উঁচু পাহাড়ের বুক চিড়ে নামানো রাস্তাটি এখন অনেক নীচে নেমে এসেছে। তবু যেন পাহাড় কাটার শেষ নেই মাটি কাটার ট্রাক্টর পাহাড়ের বুক বিদীর্ণ করে চলছে। যান্ত্রিক শব্দটা এখনও বিশাল পাহাড়ের প্রাচীর ভেদ করে বাইরে আসতে পারছে না। তবে জায়গাটা আগের চেয়ে অনেক খোলামেলা দেখাচ্ছে।
বুনো পরিবেশটা এখন আর নেই কিন্তু পাহাড়ী আদলটা রয়ে গেছে। এটাও হয়ত একদিন বিলীন হয়ে যাবে। সৌরভ টাকা জমা দিয়ে একাডেমিক ভবনে যায়। পুরাতন লাইব্রেরীতে এখন একাডেমিক কাজ-কর্ম হয়ে থাকে। সে ফরম জমা দিয়ে রসিদ বুঝে নেয়। মূল সার্টিফিকেটের জন্য রসিদটি নিয়ে দশদিন পর যোগাযোগ করতে বলে।
আর্টস ফ্যাকালটির সামনের পাহাড়টিতে রাস্তার দক্ষিন পাশে খুব সুন্দর লাইব্রেরী ভবন গড়ে উঠেছে। জায়গাটি অপরিচিত মনে হয় এখন। পাহাড়ের ঢালে আগে বেশ কয়েকটি চা-বিস্কিটের দোকান ছিল। কলা আর পাউরুটি পাওয়া যেত সবসময়। সৌরভ লাইব্রেরীতে উঠার সিঁড়ির গোড়ায় এসে দাঁড়ায়। সকালের মিষ্টি রোদটা দুপুরে এত ঝাঁঝালো হয়ে উঠতে পারে ভাবাও যায় না।
রিক্সা চালক কয়েকজন সিটের উপর পা তুলে বসে আছে। টেক্সি কয়েকটিও দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার একপাশে । ছাত্র-ছাত্রীরা কেউ বাস থেকে নেমে ফ্যাকালটির দিকে যাচ্ছে আবার কেউ ফ্যাকালটি থেকে বের হয়ে বাসে উঠছে। অনেকে আবার গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে কি যেন আলাপ করছে। সৌরভ ঠিক খেয়াল করতে পারেনি। ধবধবে সাদা টয়োটা করোলা প্রাইভেট কারটি কোন সময়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।