Close proximity is a piece of sunshine - নিবিড় সান্নিধ্যে এক টুকরো রোদ (part - 12)
নিবিড় সান্নিধ্য
বিকেলের শেষ রোদটুকু গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। উঁচু উঁচু দালান সুউচ্চ দেওয়াল আটকে রাখতে পারে না হলুদ বিকালটা । দেখতে না দেখতে সুর্যের ঝলমল আলো নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তখন টক টকে লাল সুর্যটা পশ্চিম আকাশে থির হয়ে থাকে যেন। চারিদিকের গাছ-পালা আর উঁচু-নিচু ইমারত রং বদলায়। নীল আকাশে আর সবুজ পত্র পল্লবের পরতে পরতে সুর্যের রক্তিম আভা পরশ বুলিয়ে দেয়।শাহীন ছাদের উপর দক্ষিণ পশ্চিম কোনায় বসে বিভোর হয় সূর্যের এই অপরূপ দৃশ্যে। মুহুর্তের জন্যও চোখ ফেরানো যায় না। পাঁচ তলা এই বিল্ডিং এর দশ ফ্ল্যাটের তেমন কেউ বিকেলে ছাদে উঠে না। কয়েকজন কলেজে পড়া মেয়ে মাঝে মাঝে উঠে ঈশান কোনায় দাঁড়িয়ে এক অপরকে ইশারায় কি যেন দেখায়। কখনো কখনো ইরিনা যেচে ওদের সাথে আলাপ করে। দু'এক জন টিভিতে অভিনয় করা মেয়েদের কায়দায় কথা বলতে চেষ্টা করে। তবে কথা বলার সময় বেশ সম্মান দেখায় ইরিনাকে।
শাহীন ওদিকে কখনো তাকায় না। তবুও কথোপকথন থেকে সহজে বুঝতে পারে ওদের আচরণ। ওরা ছাড়া বিকেলে আর কেউ উঠে না ছাদে। কেউ না থাকলে বেশ ভালো লাগে শাহীনের। ইরিনা পায়চারী করে পুরা ছাদে, আর যেন বসে বসে ডুবে যায় নৈসগিকতায়।
এখানে বসলে শহরের যান্ত্রিকতার ভেতর থেকে কিছুটা দূরে সরে যেতে পারে সে। বিল্ডিং সংলগ্ন রাস্তায় চলমান যানবাহনের আওয়াজ তেমন কানে আসে না, এত উঁচু থেকে চোখেও পড়েনা। তারপর বিস্তীর্ণ মাঠের সবুজ ঘাস পড়ন্ত বিকেলে তরুণ খেলোয়ারদের পদচারণায় যেন মুখরিত হয়ে উঠে। ওপাশে দেব পাহাড়ের কোল ঘেষে গড়ে উঠা দালান কোঠা গাছের সবুজ ডাল পালার ফাঁকে নগর জীবনের ধূসরতাকে সজীব করে তোলে। এসব দৃশ্যাবলী এই বিল্ডিং এর আর কাউকে টেনে আনতে পারে না। মেয়েগুলোকে না।
নতুবা এরা পশ্চিম দিগন্তে মুখ করে দাঁড়ায় না কেন? পূর্বাকাশে তখন অবশ্য রাজ হংস সাদা পাখা বিস্তৃত করে সব পালক মেলে ধরে যেন। একখন্ড সাদা মেঘ তখন ভাসতে ভাসতে উত্তর আকাশে পাড়ি জমায় এসব দৃশ্য কি কখনো ওদের কথা থামিয়ে দেয় না? নির্বাক করে তোলে না একবারও ওদের? না যতক্ষণ ওরা দাঁড়ায় চুপিচুপি কি যেন বলে । আকাশের দিকে তেমন তাকায় না। ইরিনাও সবসময় এখানে শাহীনের পাশে বসে থাকতে চায়না।
কিছুক্ষণ বসে উঠে পড়ে। পায়চারী করে চারিদিকে দুরের কোথায় কি দৃশ্য কেমন লাগছে তার বর্ণনা করে শাহীনের কাছে। মুখের বর্ণনায় এসব প্রাকৃতিক দৃশ্য ভালো লাগে না। সে মনে মনে কিছুটা বিরক্ত হলেও ইরিনাকে দেখায় না । এরকম অনেক প্রসঙ্গ আছে যা ইরিনাকে বুঝতে দেয় না শাহীন।
বাসাটি ছেড়ে দিয়ে আরেকটি বড় বাসা নেওয়ার জন্য ইরিনা বছর খানেক থেকে বলে আসছে। কিন্তু শাহীন নানা যুক্তি দেখিয়ে প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যায়। কোন কোন সময় বেশ অসুবিধায় পড়তে হয় ওদের। বিশেষ করে যখন মেহমানদের রাতে থাকার প্রশ্ন আশে। ড্রইংরুমের ফ্লোরে বিছানা পাততে হয়। মুরুব্বী গোচরের কোন মেহমান এলে ইরিনা তখন বেশ বিব্রত বোধ করে। কখনো কখনো অপমানও লাগে নিজের কাছে।
মেহমান এলে কখনো এই প্রসঙ্গে কথা বলে না ইরিনা, চুপ করে করে ভেতরে ভেতরে সব হজম করে। দু'রুমের আধুনিক ডিজাইনের বাসাটির দক্ষিণে বেলকনিতে চমৎকার বাতাস আসে। পশ্চিমের রুমের জানালা খোলা রাখলে ফাঁকা মাঠের ফুরফুরে বাতাস তিন তলার ছোট্ট রুমগুলিকে গ্রীষ্মের ভর দুপুরেও ছায়াশীতল রাখে। পাক ঘর, ডাইনিং স্পেস আর বেড রুম সংলগ্ন বাথরুম বাসাটির মেইন দুই রুমকে পৃথক করে রেখেছে। এইটুকু জায়গায় সহজে তিন রুমের একটি বাসা তৈরী করা যেতো তখন ভাড়াও অনেক বেশী হতো। কিন্তু কি মনে করে বাড়ীর মালিক এমন ঘর করলো বুঝা যায় না।
প্রথম প্রথম কোন অস্বস্তিবোধ করেনি ইরিনা । রুম ছোট হলেও বেশ পরিপাটি করে রেখেছে সে। মাঝে মাঝে 'সানন্দা'র নতুন ডিজাইন দেখে ঘরের সাজ পরিবর্তন করে সে। বেশ নতুনত্ব ফিরে আসে ঘরটিতে তখন। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনেরা ইরিনার রুচিবোধের খুব প্রশংসা করে বছর খানেক পর ঘন ঘন ঘরের সাজ পাল্টানোর সময় হয় না আর, সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হয় কৃতিকে নিয়ে। কয়েক মাস থেকে একটু একটু হাঁটতে চেষ্টা করে।
এ বাসায় হাঁটার তেমন সুযোগ নেই ড্রইং রুমে শোফা সেট, শো-কেস আর বুক সেলফ; বেড রুমে খাট, ড্রেসিং টবিল, আলনা আর ওয়ার্ডোব; ডাইনিং স্পেসে ডাইনিং টেবিল। পুরা ঘরটিই জুরে আছে এসব ফার্নিচার। বেলকনিটা চিপা, কৃতিকে হাত ধরে দু'জন এক সাথে হাঁটার মত জায়গা ওখানে নেই। তবুও ইরিনা কৃতিকে দু'হাত ধরে পেছনের দিকে সরে সরে ছেলেকে হাঁটা শিখায়। দিনের বেলায় পর্দা সরিয়ে কাঁচের জানালা খুলতে সে হাত বাড়িয়ে বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে। পাশের বাসায় ভদ্রলোক ওদের আড়াই বৎসরের ছেলেটিকে নিয়ে বিকেলে কিছুক্ষণ মাঠের পাশে হেঁটে আসে।
ছেলেটি বাপের হাতের আঙ্গুল ধরে হাঁটতে হাঁটতে একের পর এক প্রশ্ন করে কৃতিকে কয়েকবার শাহীন বাইরে নিয়ে গিয়েছিল কোলে করে। মাঠের কোণায় ঘাসের উপর বসেছিল, হাঁটতেও চেষ্টা করেছিল, পারেনি। এখনও মা'র সাথে ছাড়া অন্য কারো সাথে হাঁটতে পারে না। হয়ত কয়েকমাস পর পারবে। আর ছেলেরা সারা মাঠ জুড়ে বল আর ক্রিকেট খেলে, কোন মুহুর্তে বল ছুটে এসে পড়ে বলা যায় না । এতটুকু ছোট বাচ্চাকে নিয়ে কেউ আসে না মাঠে। মোটামুটি যারা হাঁটতে পারে তাদের নিয়ে অনেকে মাঠের দক্ষিণ পাশের রাস্তাটিতে দাঁড়ায়।
শাহীনও মাঝে মাঝে ছেলেকে কোলে নিয়ে রাস্তাটিতে হাঁটাহাটি করে শাহীন যতটাকা বেতন পায় তার অর্ধেকই ঘরভাড়ায় চলে যায়। বাকী টাকায় ছেলের দুধ, পথ্য, ঔষধপত্র আর সংসারে খরচ চলে, কোন সময় তেমন অনুবিধায় পড়তে হয় না, নিতান্তই বড় ধরনের কোন খরচের সম্মুখীন না হলে যেমন ছেলের জন্মের সময় ক্লিনিকের বিল কিংবা অনিচ্ছা সত্ত্বেও আকিকার মত অনুষ্ঠানের খরচ বহন করতে হলে ইরিনা সাধারণ মেয়েদের মত সংসারের হিসাব-নিকাশে খুব আন্তরিক।
শাহীনের সাধ্যের বাইরে কোন কিছুর উপর সে চাপাচাপি করে না কিন্তু ছেলের আকিকার খরচ এবং বড় বাসার বেশী ভাড়ার টাকা কোথা থেকে আসবে সে বিষয়টা বুঝতে ছায় না মাঝে মাঝে এমনভাবে দেখায়, কিছু কিছু আনুষ্ঠানিকতা আছে যা না করলে হয় না, আত্মীয় পরিজন বন্ধুমহলে মাথা হেট হয়ে যায়। এসব প্রসঙ্গ উঠে প্রায় সময় রাতের খাওয়া দাওয়া শেষে। তখন টিভিতে দশটার ইংরেজী সংবাদ পড়া শেষ হয়ে যায়। শাহীন কোন যুক্তি দেখায় না, শোফায় হেলান দিয়ে বসে পরবর্তী অনুষ্ঠানের দিকে মনোযোগ দেয়।
ইরিনাও কথার ফাঁকে ফাঁকে টিভির পর্দায় তাকায়। ভালো সিরিয়াল হলে সেও বেশ উপভোগ করে। কিন্তু টিভির অনুষ্ঠান মনযোগ আকর্ষণ করতে না পারলে কথাগুলো আবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তোলে। শাহীন শুনেও নির্লিপ্ত থাকে, কোন জওয়াব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। শোফার সামনের টি-টেবিল হতে দৈনিক পত্রিকা কিংবা পাশের বুক শেলফ হতে কোন ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করে। ইরিনা কয়েকবার চেষ্টা করে শাহীনের দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে পারে না। চুপচাপ বসে সে ম্যাগাজিনের পাতা উল্টায় একের পর এক।
একক সময় ইরিনা হতাশ হয়ে উঠে চলে যায় এখান থেকে বেড রুমে গিয়ে লাইট অফ করে শুয়ে পড়ে বিছানায়। শাহীন কিছুক্ষণ পত্র-পত্রিকা দেখে, সাথে সাথে টিভির অনুষ্ঠানও। কোনটাতে মনোযোগ থাকে না। সীমাবদ্ধতা বড় হয়ে ধরা দেয় ভেতরে ভেতরে। জাতীয় স্কেলের বেতনে যেটুকু ঘরভাড়া পায় তার চেয়েও বেশী টাকা চলে যায় এই ঘরের ভাড়ায় সংসার এখনও ছোট বলে বাকী টাকায় খরচ মেটানো সম্ভব হয় নতুবা এই বাসায়ও থাকা যেতো না। আরো কম ভাড়ার বাসা খুঁজতে হতো। এই কথাটা ইরিনা বুঝেও বুঝেনা কেন শাহীন ভেবে কুল পায় না।
তখন হঠাৎ কারেন্ট চলে যায়। শাহীন টিভি অফ করে পশ্চিমের জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়। পর্দা সরিয়ে বাইরের দিকে তাকায়। নীচে খোলা মাঠ তরল আঁধারে ছেয়ে আছে । উপরের খুব সুন্দর আকাশ দেখা যায়। খন্ড খন্ড মেঘের মায়াবী। আঁধারে আকাশটা ঘিরে রেখেছে। মেঘের ওপর মেঘ ভর করে ভেসে চলে উত্তর দিগন্তে।
খানিক তাকাতে না তাকাতে চাদখানি বেরিয়ে আসে গাঢ় একটুকরা মেঘের আড়াল থেকে। চারিদিকের মায়াবী আঁধার মুহুর্তে মিলিয়ে যায়। সারি সারি মেঘ চাঁদের আলোতে হেসে উঠে। তারা আর নক্ষত্র খচিত আকাশে চাঁদকে এত উজ্জ্বল দেখায় না। মেঘ ভাঙ্গা চাঁদের আলো আকাশের সীমানা পেরিয়ে দেব পাহাড়ের গাছ-গাছালির পত্র-পল্লবে ভর করে যেন। শাহীন চাঁদের দিক থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারেনা। মাতাল করা জ্যোৎস্না ওকে ক্রমশঃ বিভোর করে তোলে। সে নির্বাক দৃষ্টি মেলে চাঁদ আর মেঘের লুকোচুরিতে। হঠাৎ ইরিনার হাতের স্পর্শে সে একটু অবাক হয়।
ইরিনা এতক্ষণের নিঃশব্দতা ভেঙ্গে বলে, কি সুন্দর চাঁদ দেখা যাচ্ছে আজ। শাহীন চোখ না ফিরিয়ে মন্তব্য করে, সব বাসা থেকে এত চমৎকার করে চাঁদ দেখা যায় না। ইরিনা নিঃশব্দে সায় দেয় শাহীনের কথায়। শাহীন ওর দিকে না তাকিয়ে বুঝতে পারে । তখন দু'জন একসাথে পুলকিত হয় চাঁদের জ্যোৎস্নায়।