জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ইসলামের শাশ্বত শিক্ষা ( কুরআন ও হাদীসের আলোকে)

Mofizur Rahman
0

জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ইসলামের শাশ্বত শিক্ষা ( কুরআন ও হাদীসের আলোকে)

জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ইসলামের শাশ্বত শিক্ষা ( কুরআন ও হাদীসের আলোকে)

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

  • জঙ্গিবাদ কখনো ইসলামের শিক্ষা হতে পারে না।
  • জঙ্গিবাদ কখনো কুরআনের শিক্ষা হতে পারে না।
  • জঙ্গিবাদ কখনো হাদীসের শিক্ষা হতে পারে না।
  • জঙ্গিবাদের উত্থান বনাম ইসলামের শান্তির শিক্ষা।
জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ইসলামের শাশ্বত শিক্ষা ( কুরআন ও হাদীসের আলোকে):
জঙ্গি তৎপরতা বর্তমান বিশ্বের এক জটিল বাস্তবতা। বর্তমানে জ্ঞানবিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের সাথে প্রতিযোগিতা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে এ অশুভ তৎপরতা। জঙ্গি তৎপরতা একদিকে যেমন বিশ্বশান্তিকে হুমকির মুখে দাঁড় করে দিয়েছে, অপরদিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে সভ্যতার সৌধকে। বর্তমানে জঙ্গি তৎপরতা কোনো বিচ্ছিন্ন কর্মকাণ্ড নয়। এটি একটি রীতিমত মতবাদে পরিণত হয়েছে।

(বর্তমানে প্রচলিত অর্থে) এর উদ্দেশ্য ধর্মীয় কারণে রাজনৈতিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে কিংবা কোনো নির্দিষ্ট মতবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উগ্রতা ও চরমপন্থা প্রদর্শন। আর এর সাধারণ ও প্রচলিত রূপ হলো চোরা গোপ্তা হামলা, অতর্কিত আক্রমণ, হত্যা করা, আত্মঘাতী হামলা কিংবা নৈরাজ্য সৃষ্টি করে আতঙ্ক তৈরি করা। বর্তমানে এর সূত্র ধরে ও বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে জঙ্গিবাদের নানা শ্রেণিবিভাগও তৈরি হয়েছে। যেমন- সাইবার, নিউক্লিয়ার, বায়ো, রাজনৈতিক, সেপারেটিস্ট ও ধর্মীয় জঙ্গিবাদ।

তাই এখন যৌক্তিক কারণেই জগতের অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি জঙ্গিবাদ নিয়ে ব্যাপক বিশ্লেষণ গুরুত্ব পাচ্ছে। জিজ্ঞাসা জেগেছে, বর্তমান বিশ্বে জঙ্গিবাদের এই বিপুল উত্থান কিসের কারণে? সে কি দারিদ্রের কষাঘাত, ধর্মীয় উন্মাদনার যুক্তিহীন উন্মেষ, রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের কুটিল অভিপ্রায়, নাকি সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে অবরুদ্ধ বিদ্রোহ?

অনেক সন্ত্রাস বিশ্লেষকই আধুনিক জঙ্গিবাদের মূল কারণ রিলিজিয়াস ফ্যানাটিজম বা ধর্মীয় উন্মাদনার বিস্তার বলে বিশ্বাস করেন। ধর্মীয় উগ্রতা জঙ্গিবাদের পরিবেশ সৃষ্টিতে অনুকূল ভূমিকা তৈরি করতে অবশ্যই সহায়ক হয়। আমরা দেখতে পাই যে, একটি শ্রেণি প্রত্যেকটি যুগে ধর্মের নামে অরাজকতা তৈরি করে আসছে। ইহুদী উগ্রবাদী ধার্মিকরা 'ধর্মীয় আদর্শ ও 'ধর্মীয় রাষ্ট্র' প্রতিষ্ঠার জন্য যুগে যুগে সন্ত্রাসের আশ্রয় নিয়েছে। মধ্যযুগে খ্রিষ্টানরাও ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণে বহু সন্ত্রাসী ঘটনা সংঘটিত করেছে। অনুরূপভাবে উগ্রবাদী হিন্দু ও বৌদ্ধদের দ্বারাও নানা সময় ধর্মীয় কারণে বিভিন্ন সন্ত্রাসী ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।

ইসলামে সর্বপ্রথম বিচ্ছিন্নতাবাদী খারিজীরা ধর্মের বিধান প্রতিষ্ঠার নামে চরম অরাজকতা সৃষ্টি করেছিল। তাঁদের হাতেই ইসলামের চতুর্থ খালীফা সাইয়িদুনা আলী (রা.) শাহাদাত বরণ করেন। কিন্তু সে ধর্মীয় উন্মাদনাই কী একমাত্র মূল কারণ? পৃথিবীর নানা ধর্মমতে এমন অজস্র অনুসারী রয়েছেন, যারা নিজেরা ধর্মের একান্ত অন্ধ ভক্ত হয়েও কোনো ধরনের সহিংস নীতির প্রতি মোটেও বিশ্বস্ত নন। জঙ্গিবাদকে আদপেই নিজেদের বিশ্বাস প্রচারের অস্ত্র হিসেবে তাঁরা ব্যবহার করতে পছন্দ করেন না।

তাহলে জঙ্গিবাদ সৃষ্টির পেছনে কোন্ অন্তর্নিহিত কারণগুলো বিদ্যমান? এর নিগূঢ় উত্তর হলো, জঙ্গি মানসিকতা নিশ্চিতভাবে সমাজের কিছুসংখ্যক মানুষের এমন এক সাইকোলজিক্যাল বৈশিষ্ট্য, যা শক্তিমান প্রভাবশালীদের কাছ থেকে আর্থিক, নৈতিক, আদর্শগত ও আইনগত আনুকূল্য লাভ করে মানবসমাজের ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে এবং পরিস্থিতিতে একেকভাবে বাস্তবতা পায়। বাস্তবে তার সক্রিয় প্রকাশ তখনই ঘটে, যখন এ হীন মনস্তত্ত্ব দেশীয় শক্তি কিংবা আন্তর্জাতিক মহলের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক কিংবা ধর্মীয় আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়।

আধুনিক জঙ্গিবাদের আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট আমাদের সকলেরই কমবেশি জানা আছে। এর একদিকে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আধিপত্যবাদী পশ্চিমাদের ভূমিকা, যা মুসলিম সমাজে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিচ্ছে। এ ক্ষোভের ন্যায্য ভিত্তি আছে এবং তার কারণগুলো প্রতিকার না করে উত্তরোত্তর ক্ষোভের ইন্ধন জোগানোর ফলে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ মুসলিম তরুণদের মনে প্রতিহিংসারও জন্ম হচ্ছে। অপরদিকে মুক্ত ও উদার চিন্তার বন্ধ্যত্বের ফলে আজকের সমস্যার যে আন্তর্জাতিক রূপ তা আধিপত্যবাদ বিরোধী রাজনীতিকে শক্তিশালী না করে জন্ম দিচ্ছে ধর্মান্ধ জঙ্গিবাদের।

অথচ আধিপত্যবাদ নিজের হীন স্বার্থেই রাজনৈতিক জ্ঞানহীন ধর্মান্ধের দল সৃষ্টি করে এবং নিজ স্বার্থে ইচ্ছেমতো তাদের ব্যবহারও করে এবং প্রয়োজনে তাদের ধ্বংসেও মেতে ওঠে। যেমনভাবে তালেবান ও আল-কায়েদার ক্ষেত্রে ঘটেছে। আফগানিস্তানে রাশিয়ার বর্বরতার প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধনে তালেবানদের উত্থান এবং ২০০১ সালে সেই তালেবান শাসিত আফগানিস্তানের ওপর আমেরিকার হামলে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। পাশাপাশি ইঙ্গ-মার্কিন বলয়ের ছত্রছায়ায় সৃষ্টি হলো আলকায়েদা, আবার তারাই এর ধ্বংসে মেতে ওঠেছে।

আর বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী যে দলটি তার বিষাক্ত ফণা তুলেছে এবং একের পর এক মারাত্মক ছোবল মেরে যাচ্ছে, সেই আইএসও মূলত পশ্চিমা পরাশক্তির প্রচ্ছন্ন মদদে মোসাদেরই সৃষ্টি। এ তথ্য আজ বিশ্বব্যাপী অনেকেই জানে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষত্যাগী গুপ্তচর অ্যাডওয়ার্ড স্নোডেনের প্রকাশিত 'গোপন দলীল'-এর তথ্যানুযায়ী জর্দানের অভ্যন্তরে গোপন ক্যাম্পেই যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা 'মোসাদ' আইএস জঙ্গিদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিতো।

বাংলাদেশ প্রতিদিন'-এর রিপোর্ট অনুযায়ী গুলশানের হোলি আর্টিজানের ঘটনাটি ঘটার পরপরই জনৈক রিটা কাটজের সাইট ইনটেলিজেন্স এ সংক্রান্ত খবরসহ আইএস-এর দায় স্বীকার প্রচার করে। ওই ঘটনায় ২০ জন নিহত হওয়ার খবরও রেস্টুরেন্টের ভেতরের ছবিসহ সবার আগে রিটা কাটজের সাইটেই প্রকাশিত হয়। এমনকি পাঁচ জঙ্গির ছবি পুলিশ প্রচার করার আগেই এ রিটা কাটজের সাইটেই দেখা যায়। এ রিপোর্ট থেকে স্পষ্টত বোঝা যায়, ভেতরের এ ছবি ও খবর ভেতর থেকে তাদের কেউ তার কাছে পাঠিয়েছে।

কে এই রিটা কাটজ? ইহুদী বংশোদ্ভূত মোসাদের গুপ্তচর হিসেবে খ্যাত এই রিটা কাটজ ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নাগরিক। যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউজ, এফবিআই, সিআইএ, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ, বিচার বিভাগ, অর্থবিভাগসহ গুরুত্বপূর্ণ সব মার্কিন দফতরে তিনি চাকরি করেছেন। শুধু তা-ই নয়, ইসরাইলে সামরিক বাহিনীতেও তিনি কর্মরত ছিলেন। তাছাড়া উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ জানিয়েছেন, হিলারি ক্লিনটন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আইএসসহ জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্র সরবরাহের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন।

হিলারি ক্লিনটনের ফাঁস হওয়া ই-মেইল থেকে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে ডেমোক্র্যাসি নাউকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ দাবি করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারিকে আইএস-এর প্রতিষ্ঠাতা বলেও উল্লেখ করেন। এ সব তথ্য যদি সত্য হয়, তাহলে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, এ সব জঙ্গি ঘটনা ইহুদী মার্কিন চক্রের পরিচালনায় ঘটছে। বলাই বাহুল্য, বিগত দেড় হাজার বছর ধরে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে "জিহাদ'-এর নামে এরূপ সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ কখনোই দেখা যায়নি।

রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত যুদ্ধ ব্যতীত কোথাও কোনো মুসলিম ব্যক্তিগতভাবে বা দলগতভাবে কাউকে গুপ্ত হত্যা করেছে বা কারো বাড়িতে অগ্নি সংযোগ করেছে বা আত্মঘাতী হামলা করেছে... ইত্যাদির কোনো নযীর আমরা দেখতে পাই না। সর্বপ্রথম বিংশ শতাব্দীর ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে, বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরেই অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। এ সময় পাশ্চাত্য চিন্তাবিদ ও রাজনীতিকরা “ইসলামের সাথে পাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বন্দ্ব'-এর থিওরি উপস্থাপন করেন। তাঁরা ইসলামকে পাশ্চাত্যের, আরও বিশেষভাবে ইহুদী ও খ্রিষ্টানদের প্রতিপক্ষ হিসেবে ঘোষণা করেন।

তাঁরা ভালোভাবেই উপলব্ধি করেন, মুসলিম বিশ্বকে তার নিজ গতিতে অগ্রসর হতে দিলে একবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেই তারা বিশ্বশক্তিতে পরিণত হবে। অর্থনৈতিক স্থিতি, প্রাযুক্তিক ও সামরিক শক্তিতে তারা শক্তিশালী হয়ে যাবে। ফলে তাদেরকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরানোর কোনো সুযোগ থাকবে না। কাজেই বোঝা যায় যে, 'সভ্যতার দ্বন্দ্ব' থিওরি আবিষ্কারের পরেই পশ্চিমারা, বিশেষ করে ইহুদী-মার্কিন চক্র নিজেদের প্রয়োজনে ইসলামের ভাবমর্যাদা বিনষ্ট করা এবং মুসলিমদের আর্থ-সামাজিক অবস্থানকে দুর্বল করার হীন মানসিকতা থেকে জঙ্গিবাদ ইস্যুকেই সর্বোত্তম পলিসি হিসেবে গ্রহণ করেন এবং তাঁদের স্বার্থেই জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করেন।

ইদানীং বিশ্বে ইসলামকে জঙ্গি কার্যকলাপ ও সন্ত্রাসের সাথে একাকার করে ফেলার জোর চেষ্টা করা হচ্ছে। বাংলাদেশসহ মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ যেভাবে ক্রমশ অর্থনৈতিক উন্নতি ও সামাজিক সমৃদ্ধি অর্জনের পথে এগুচ্ছে, তা দেখে বিশ্বের আধিপত্যবাদী চক্র বিশ্বময় ইসলাম, মুসলিম ও মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত ষড়যন্ত্র করে চলছে। কাজেই বর্তমানে বিভিন্ন দেশে নানা নামে ধর্মান্ধ জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীগুলো যে সকল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে তা তাদের ইন্ধন ও আশ্রয়-প্রশ্রয়ে হয়ে থাকতে পারে এবং এর কিছু প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে।

যে সব দেশে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের সুষ্ঠু চর্চার অভাবের ফলে দীর্ঘদিন ধরে মুসলিমরা নিগৃহীত হচ্ছে, আধিপত্যবাদীদের অনুচররা সেখানকার হতাশাগ্রস্ত ধর্মপ্রাণ তরুণদেরকে বাছাই করে সংঘাতের পথে যেতে প্ররোচিত করছে। এরা 'জিহাদ' ও 'কিতাল' বিষয়ক আয়াত ও হাদীসগুলোর অপব্যাখ্যা করে তাদেরকে ‘প্রিম্যাচিউরড' সংঘাতের পথে যেতে উস্কানি দিচ্ছে। এ অবস্থায় যদি আবেগপ্রবণ তরুণরা ইসলামের সঠিক শিক্ষা ও নির্দেশনা জানতে না পায়, তবে তারা উগ্র ও চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে। বস্তুতপক্ষে ইসলাম বিদ্বেষী শক্তি গোপন অর্থায়নে এ বিভ্রান্ত তরুণদের নিয়ে জঙ্গিবাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে।

এ সকল মুসলিম তরুণ তাদের ফাঁদে পা দিয়েছে। অথচ এদের অনুধাবন করা উচিত, ইসলামের দৃষ্টিতে এরূপ কাজ চরম অন্যায় ও জঘন্য পাপ। কারণ, ক. ইসলাম অন্যায়ের প্রতিবাদ অন্যায় পদ্ধতিতে করতে অনুমতি দেয় না, খ. ইসলাম একের অপরাধে অন্যকে শাস্তি প্রদানের অনুমতি দেয় না ওগ, ইসলাম কোনো ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীকে বিচার বা শাস্তির দায়িত্ব নিজের হাতে তোলে নেওয়ার অনুমতি দেয় না। এজন্য কোনো দেশের প্রাজ্ঞ আলিম ও মুফতীগণ কখনোই এ জাতীয় প্রতিশোধ বা প্রতিবাদ বৈধ বলেননি। তারা এ সব পরিস্থিতিতে সহিংসতা বর্জন করে পরম ধৈর্যের সাথে ও শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ ও নিন্দা আপনের পরামর্শ দেন।

তদুপরি এ বিভ্রান্ত তরুণদের আরো উপলব্ধি করা উচিত, এ জঙ্গিবাদের কোনো ভবিষ্যত নেই। এটা দেশ ও জাতির জন্য কখনোই কোনো সুফল বয়ে আনবে না। এটা শুধু সমাজে বিশৃঙ্খলা ছড়াবে। উপরন্তু, তা ইসলামের ইমেজকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ইসলামে জঙ্গিবাদ বা চরম ও উগ্রপন্থা অবলম্বনের কোনো অবকাশই নেই। ইসলাম সর্বক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দেয়। ইসলাম, এমনকি পৃথিবীর কোনো ধর্মই কখনোই বোমাবাজি, হত্যা, গুপ্তহত্যা, আত্মঘাতী হামলাসহ কোনো ধরনের অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা সমর্থন করে না।

বস্তুতপক্ষে শান্তি, নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মহান ব্রত নিয়েই ইসলাম পৃথিবীতে এসেছে। ইসলাম শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো শান্তি, নিরাপত্তা। এ জীবন ব্যবস্থার এরূপ নামকরণই প্রমাণ করে যে, মানুষের জীবনের সর্বক্ষেত্রে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার চিন্তা ইসলামের সামগ্রিক প্রকৃতি ও মৌল দৃষ্টিকোণ থেকে উৎসারিত। পরস্পর সাক্ষাতের সময় ইসলাম একে অপরকে স্বাগত ও অভিবাদন জানানোর যে ভাষা ও নিয়ম শিখিয়েছে তা হলো একে অপরের শান্তির জন্য প্রার্থনা করা। ঈমানের পর ইসলামের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ফারয 'সালাত'ও শেষ করা হয় সকলের শান্তি ও নিরাপত্তা কামনা করেই। এভাবে ইসলামের প্রতিটি আদেশ-নিষেধ ও বিধিবিধান থেকে শান্তির ফল্গুধারা নিঃসৃত হয়।

উপরন্তু, সমাজের শাস্তি ময় পরিবেশের স্থায়িত্ব বজায় রাখার জন্য শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে এমন সকল কর্মকাণ্ড ইসলামে চরমভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাই যৌক্তিকভাবে ইসলাম শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার স্বার্থে সব ধরনের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপকে প্রতিরোধ ও প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে নির্মূল করার নির্দেশনা দান করে। জঙ্গি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জনগণের শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা এবং তাদের মৌলিক অধিকারসমূহ দলন করা দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করার নামান্তর, যা ইসলামে সম্পূর্ণরূপে হারাম। আল্লাহ তা'আলা বলেন,
ولا لفسدوا في الأرض بعد إصلاحها ذلكم خير لكم إن كنتم مؤمنين؟

“জমিনে শাস্তি স্থাপনের পর তোমরা সেখানে বিপর্যয় ঘটাবে না। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা ঈমানদার হও।"

অন্য আয়াতে তিনি বলেন,
كما أحسن الله إليك ولا تبع الفساد في الأرض إن الله لا يجب (وأحسن المفسدين)
“তুমি অনুগ্রহ করো, যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। এবং পৃথিবীতে অনর্থ ও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ অনর্থ, বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের পছন্দ করেন না।

এসব আয়াতে যেসব কার্যকলাপ দেশে অশান্তি, নৈরাজ্য ও বিপর্যয় সৃষ্টি করে যেমন দাঙ্গা-হাঙ্গামা, জ্বালাও-পোড়াও, বোমাবাজি ও হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি, তা থেকে আল্লাহ তা'আলা তার মু'মিন বান্দাহদেরকে নিষেধ করেছেন। এভাবে আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুর'আনের বহু জায়গায় মানবহত্যা, অন্যায়ভাবে কাউকে আহত করা, অন্যের সম্পদ নষ্ট করা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করা থেকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।

বস্তুতপক্ষে ইসলামে অন্যের জানমাল ও ‘ইযযাত-আক্র এবং জাতীয় সম্পদ অত্যন্ত পবিত্র ও আমানতস্বরূপ । এগুলোর ওপর অন্যায়ভাবে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করা ইসলামে চরমভাবে নিষিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ (সা.) বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা দেন,
إن دماءكم، وأموالكم، وأغراضكم، حرام عليكم كحرمة يومكم هذا في شهركم هذا في بلدكم هذا .
“তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ, তোমাদের সম্মান পরস্পরের জন্য ঐরূপ হারাম, যেরূপ এই শহর, তোমাদের এই মাস এবং তোমাদের এ দিনের পবিত্রতা নষ্ট করা হারাম।

বিশিষ্ট সাহাবী 'আবদুল্লাহ ইবনু 'আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)কে কা'বা শরীফ তাওয়াফ করতে দেখলাম। এ সময় তিনি কা'বা শরীফকে সম্বোধন করে বললেন,
ما أطيبك وأطيب ريحك ، ما أعظمك وأعظم حرمتك ، والذي نفس محمد بيده الحرمة المؤمن أعظم عند الله حرمة منك ، ماله ودمه
“(হে কা'বা)! তুমি কতো পবিত্র। তুমি কতো সুরভিত। তুমি কতো মহান! তোমার মর্যাদা কতো বিশাল। সে যাতের কসম, যাঁর পবিত্র হাতে আমার প্রাণ! নিশ্চয় আল্লাহর নিকট একজন মু'মিনের মর্যাদা তোমার মর্যাদার চেয়ে বেশি। তেমনি তার সম্পদ ও রক্তও।

" অন্য একটি হাদীসে তিনি বলেন,
ومن شاق شق الله عليه يوم القيامة ... ومن استطاع أن لا يحال بينه وبين الجة بمل، كف من دم أهراله فليفعل (كأنما يذبح دجاجة كلما يعرض لباب من أبواب الجنة حال بينه وبينه)
“যে ব্যক্তি কঠিন বা উগ্রপথ অবলম্বন করবে, আল্লাহ তা'আলাও কিয়ামাতের দিন তার জন্য কঠিন পথ অবলম্বন করবেন। ... কেউ যদি কোনো মানুষের হাতের তালুতে রাখার মতো সামান্য রক্তও প্রবাহিত করে (যেন সে মুরগি যবাই করেছে), তবে সে রক্ত তার ও জান্নাতের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। (যখনই সে জান্নাতের কোনো দরজার দিকে অগ্রসর হবে, তখন ঐ রক্ত তার জান্নাতে প্রবেশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।) কাজেই যদি কেউ পারে, তবে সে যেন এরূপ রক্তপাত থেকে আত্মরক্ষা করে।

বস্তুতপক্ষে শান্তি-শৃঙ্খলা বিরোধী যে কোনো উগ্রতা ও কার্যকলাপের সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র জীবনাদর্শ দ্বারা এ কথা সুপ্রমাণিত যে, জাতীয় শান্তি ও নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে এমন কোনো কাজ তিনি সমর্থন করেননি। উপরন্তু, বিশ্বে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তাঁর নীতি। আল্লাহ তা'আলা তাঁকে অশান্ত ও বিশৃঙ্খল পৃথিবীতে শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য রাহমাত হিসেবে প্রেরণ করেন। এ জন্য তিনি সর্বদাই দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য সচেতন ও তৎপর ছিলেন এবং সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য প্রতিরোধে বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেন।

মাদীনায় হিজরাতের পর তিনি মাদীনায় স্থায়ীভাবে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধের জন্য মাদীনায় বসবাসকারী সব ধর্মের লোকদের সাথে শান্তি-চুক্তি সম্পাদন করেন, যা ইতিহাসে 'মাদীনার সনদ' নামে খ্যাত। এ সনদ অনুযায়ী কেউ অন্যায়-অবিচার করলে, দাঙ্গা-হাঙ্গামা বা কোনো রূপ নৈরাজ্য সৃষ্টি করলে সকল ঈমানদার তাদের বিরোধিতা করবে। অধিকন্তু, কোনো নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীকে কেউ সাহায্য করতে পারবে না কিংবা আশ্রয় দিতে পারবে না।

তাছাড়া রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজেও সন্ত্রাস প্রতিরোধে সন্ত্রাসীদের উপযুক্ত শান্তি নিশ্চিত করতে দ্বিধাবোধ করতেন না। কারণ তিনি জানতেন, সন্ত্রাসকে অঙ্কুরেই নির্মূল করা না হলে তা ক্রমেই বিস্তার লাভ করবে। তখন ইচ্ছা হলেই তা আর নির্মূল বা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। ইহুদী গোত্র বানূ নাদীর রাসূলুল্লাহ (সা.)কে সন্ত্রাসী হামলার মাধ্যমে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। ঘটনা প্রমাণিত হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদেরকে তাদের আবাসস্থল থেকে উৎখাত করে অন্যত্র পাঠিয়ে দিয়ে মাদীনাকে সন্ত্রাসমুক্ত করেন।

তাছাড়া রাসূলুল্লাহ (সা.) সন্ত্রাসীদের নির্মূল করে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেও প্রয়োজনে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করতেন। এভাবে তিনি তাঁর সমগ্র মাদানী জীবনে দেশী ও বিদেশী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাত থেকে মাদীনাকে সন্ত্রাসমুক্ত করে সন্ত্রাস নির্মূলে বিশ্ববাসীর সামনে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে যান। সন্ত্রাস নির্মূলে তাঁর পরিচালিত কার্যক্রমের ওপর আত্মবিশ্বাস থেকে তিনি ঘোষণা দিয়ে যান,
حتى يسير الراكب من صنعاء إلى حضرموت لا يخاف إلا الله
“এমন একদিন আসবে, যে দিন একজন আরোহী একাকী সান আ থেকে সুদূর হাদরামাউত পর্যন্ত ভ্রমণ করবে। এ অবস্থায় তার অন্তরে একমাত্র আল্লাহর ভয় ছাড়া কোনো সন্ত্রাসের ভয় থাকবে না।

উল্লেখ্য যে, মুসলিম জঙ্গিবাদী বিপথগামীরা তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য ইসলামের পবিত্র পরিভাষা 'জিহাদ' শব্দটি বিকৃতভাবে ব্যবহার করে থাকে। তারা জিহাদের নামেই অধিকাংশ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিতালের প্রসঙ্গও তোলে ধরছে। এ কারণে অনেক প্রাচ্যবিদ ও আধুনিক শিক্ষিত লোকই জঙ্গিবাদের জন্য সরাসরি ইসলামকে দায়ী করেন। তারা মনে করেন যে, ইসলামের মূল শিক্ষাই জঙ্গি তৈরি করা। তাদের মতে, ইসলাম তার অনুসারীদেরকে অসহিষ্ণুতা শিক্ষা দেয়।

ইসলামে জিহাদের নামে অমুসলিমদেরকে হত্যা করার উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়েছে। আর এ কারণেই মুসলিমদের মধ্যে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে। তাঁদের মতে, এ জঙ্গিবাদ বন্ধ করার একমাত্র উপায় হলো ইসলামকে নির্মূল করা বা নিয়ন্ত্রণ করা। আমেরিকার প্রসিদ্ধ প্রভাবশালী চিন্তাবিদ ও লেখিকা অ্যান কালটার (Ann Coulter) জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনের জন্য সকল মুসলিম দেশ দখল করে মুসলিমদেরকে জোরপূর্বক খ্রিষ্টান বানানোর দাবি জানিয়ে লিখেন, We should invade their countries, kill their leaders and convert them to Christianity. - "আমাদের উচিত তাদের দেশগুলো আক্রমণ করা, তাদের নেতাদেরকে হত্যা করা এবং ধর্মান্তরিত করে খ্রিষ্টান বানানো।”

এ সকল প্রাচ্যবিদকে হয়তো অনেক মুসলিমই “ইসলাম বিদ্বেষী' বলে মনে করতে পারেন। তবে এদের অনেকের ক্ষেত্রেই এরূপ নত প্রকাশের জন্য বিদ্বেষের চেয়ে তাদের অজ্ঞতাই বড় কারণ। এরা দেখছেন যে, কোনো কোনো মুসলিম নির্বিচারে নিরপরাধ মানুষ হত্যা করছে এবং এ জন্য তারা কুর'আন থেকে উদ্ধৃতি পেশ করছে। কাজেই তাঁরা ধারণা করে থাকেন যে, কুর'আন এরূপই শিক্ষা দিয়ে থাকে। এদের অনেকেই হয়তো কুরআনের জিহাদ বিষয়ক কিছু নির্দেশ পাঠ করেছেন; কিন্তু জিহাদের প্রকৃ অর্থ কী, এর শর্ত ও বিধানগুলো কী কী তারা তা জানেননি। তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিম ধর্মপ্রচারকদের প্রচারণামূলক বইপুস্তক পাঠ করেছেন; ইসলামী জ্ঞানের সূত্রগুলো থেকে নিরপেক্ষভাবে তথ্য সপ্তাহ করেননি।

বস্তুতপক্ষে 'জিহাদ' শব্দটি কখনোই সন্ত্রাস ও অরাজকতার অর্থ বহন করে না। ইসলামী আইনের পরিভাষায় জিহাদ বলতে মুসলিম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় যুদ্ধকেই বুঝানো হয়। এটা বৈধ কোনো কর্তৃপক্ষ ছাড়া অর্থাৎ রাষ্ট্রে বা সরকার ছাড়া ঘোষণা দিতে পারে না। তা ছাড়া 'জিহাদ' শব্দটি একটি সাধারণ ও ব্যাপকার্থক শব্দ। এর অর্থ প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। এ জিহাদের কাজ শুরু হয় মানুষের ব্যক্তি জীবনের আত্মশুদ্ধির প্রচেষ্টার মাধ্যমে। তারপর নিজের আত্মীয়-স্বজন ও অন্যান্য মানুষের নিকট দীনের দাওয়াত পৌঁছানোর মাধ্যমে। এটি একটি নিয়মতান্ত্রিক অব্যাহত প্রচেষ্টা ও প্রক্রিয়া।

সর্বশেষ প্রয়োজনে যুদ্ধের মাধ্যমে জিহাদের অর্থ প্রকাশ পেয়ে থাকে। তবে তা হবে রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানের আদেশে এবং তাঁর নেতৃত্বে। পবিত্র কুর'আনে “জিহাদ” কথাটা প্রথম ব্যবহার করা হয় রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মাক্কী জীবনে । অথচ তাঁর মাক্কী জীবনে কোনো যুদ্ধ ছিল না। সেখানে দাওয়াত ছিল, কমিউনিকেশন ছিল, যোগাযোগ ছিল। এ বিষয়ে আল্লাহর নির্দেশ হলো, Kiss Sonj (হে রাসূল!) তুমি কুর'আন দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের জিহাদ চালিয়ে যাও। এখানে জিহাদ মানে, সর্বশক্তি নিয়োগ করে মানুষের কাছে আদর্শকে পৌঁছে দেওয়া। তাও মধ্যপন্থায়, যুক্তির সাথে, প্রমাণের সাথে।

এটিই কুর'আনের মাধ্যমে জিহাদ। এরপরে জিহাদের একটি অংশ হলো 'কিতাল'। সেই অংশটির নির্দেশ আসলো রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মাদানী জীবনে। রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন মাদীনা মুনাওয়ারায় গেলেন, তখন যেহেতু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তাঁর হাতে, তখন সেখানে যখন ডিফেন্সের প্রশ্ন, তখনই এ সশস্ত্র জিহাদের প্রশ্ন আসে এবং তখনই আল্লাহর পক্ষ থেকে এর অনুমতি দেয়া হয়। ১২এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা'আলা বলেন, (jabar shathi "যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হলো তাদেরকে যারা আক্রান্ত হয়েছে। কারণ, তাদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ছোট বড় মিলে প্রায় একশ'র কাছাকাছি অভিযান পরিচালনা করেন। সবগুলো অভিযান মিলিয়ে উভয়পক্ষে পাঁচশত এর কম লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। তদুপরি তিনি তাঁর সাহাবীগণকে যুদ্ধের সময় কোনো বেসামরিক নিরীহ মানুষ, নারী, শিশু ও মজুরদেরকে হত্যা করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেন। ১৬ অন্য ধর্মের ধর্মযাজককেও হত্যা করতে নিষেধ করেন। " ইসলামের দৃষ্টিতে, শত্রুপক্ষের দূত ও বাহক, বিদেশী ব্যবসায়ী, আশ্রয়প্রার্থী, দর্শনার্থী ও পর্যটককেও হত্যা করা বৈধ নয়।

মাক্কা বিজয়ের সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) এও নির্দেশ দিয়েছিলেন, কোনো আহত ব্যক্তির ওপর হামলা করবে না, কোনো পলায়নকারী ব্যক্তিকে ধাওয়া করবে না, কোনো বন্দীকে হত্যা করবে না, কোনো ব্যক্তি ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকলে তাকেও কিছু বলবে না। তাছাড়া তিনি যুদ্ধের সময় অগ্নিসংযোগ করতে, ক্ষেত-খামার ধ্বংস ও চতুষ্পদ জন্তু হত্যা করতে, গাছপালা কেটে ফেলতে এবং লুটতরাজ করতে নিষেধ করেন। শত্রুদের সাথে যুদ্ধের সময় বেসামরিক লোকদের প্রতি এমন সুসভ্য আচরণ পৃথিবীবাসী কি কখনো দেখেছে! এটি সত্যিই বিরল।

ইসলামে যুদ্ধ করা যদিও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে বৈধ; তবুও যুদ্ধের সময় কোনো অবস্থাতেই মানবতা লঙ্ঘন করা ইসলাম সমর্থন করে না। সুতরাং জিহাদের সাথে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের কোনোই যোগসূত্র নেই। অনেক প্রাচ্যবিদের কথায়ও বিষয়টি ফুটে উঠেছে। বৃটিশ রাজনীতিবিদ ও সাবেক কনজারভেটিভ এমপি লর্ড নরম্যান বলেন,
I don't think there is a link and I think the word Jihad is misunderstood and misinterpreted. It could mean a war in defence of Islam when Islam is under threat and secondly Jihad can be internal thing about conquering oneself and struggling to be a better person.

"আমি মনে করি না যে, ইসলামের সাথে সন্ত্রাসবাদের কোনো যোগসূত্র আছে। আমি মনে করি, 'জিহাদ' শব্দটি ভুলভাবে বোঝা হচ্ছে এবং ভুল ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে। জিহাদের দুটি অর্থ হতে পারে। এক. ইসলাম হুমকির মুখে পড়লে ইসলামকে রক্ষা করার জন্য পরিচালিত যুদ্ধ। দুই. জিহাদ একটি আধ্যাত্মিক বিষয়, নাফসকে কাবু করা এবং আরো ভালো ব্যক্তি হওয়ার চেষ্টা করা।”

কাজেই বোঝা যায়, ইসলামের দৃষ্টিতে রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানের আদেশ এবং তাঁর নেতৃত্ব ব্যতীত অপর কারো জন্য সশস্ত্র জিহাদ করার কোনো অবকাশ নেই। তাছাড়া রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর মধ্যে আইনানুগ বিচারের বাইরে বা রাষ্ট্রপ্রধানের নির্দেশে শত্রু বাহিনীর যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ঘোষিত ও আইনানুগ যুদ্ধের বাইরে যদি কেউ হত্যা, আঘাত, ভয়প্রদর্শন ও সম্পদ ধ্বংস ইত্যাদি কাজে লিপ্ত হয়, তার এ কাজ কখনোই জিহাদ বলে গণ্য হবে না; উপরন্তু, তা হবে জঘন্য পাপ ও হারাম কর্ম। যদি রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর বাইরে কোনো দল বা গোষ্ঠীকে এরূপ জিহাদ ঘোষণা দেয়ার অধিকার দেয়া হয়, তা হলে সমাজে বিশৃঙ্খলা, হানাহানি, মারামারি ও গোলযোগ শুরু হয়ে যাবে।

এভাবে গৃহযুদ্ধ বেধে যাবে, যার পরিণতিতে দেশ ও জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে। কাজেই আত্মঘাতী হত্যার মাধ্যমে মানুষদেরকে হত্যা করা, নিরীহ জনগণকে হত্যা করা কিংবা গুপ্ত হত্যা করা, পেছন থেকে হত্যা করা, বোমাবাজি করে মানুষ হত্যা করা, জানমাল ধ্বংস করা কিছুতেই জিহাদ হতে পারে না। ইসলাম কখনোই জিহাদের নামে এ জাতীয় অপকর্ম অনুমোদন দেয় না। উপরন্তু, জিহাদের নামে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করার চেয়ে জিহাদ না করাই অনেক ভালো। কারণ, জিহাদের নামে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করলে শত পুণ্য করেও জান্নাত থেকে বঞ্চিত হতে হবে।

পক্ষান্তরে সাধারণভাবে আজীবন জিহাদ না করলেও এরূপ শাস্তি লাভের কোনো সম্ভাবনা নেই। যেমন নামাযের শর্তাবলি পূরণ না করে কেউ যদি নামায পড়ে, তার এ নামায 'ইবাদাত বলে বিবেচিত হবে না এবং এভাবে নামায পড়ার জন্য সে গুনাহগার হবে, অনুরূপভাবে কেউ জিহাদের গুরুত্ব অনুধাবন করা সত্ত্বেও যদি জিহাদের প্রয়োজনীয় সংশ্লিষ্ট শর্তাবলি" পাওয়া না যায়, তাহলে জিহাদ বর্জন করলে কোনোরূপ গুনাহ তো হবে না; বরং এরূপ অবস্থায় জিহাদের নামে কারো ভীতিপ্রদর্শন, রক্তপাত ও সম্পদ নষ্ট করা হলে তা হবে জঘন্য কাবীরা গুনাহ।

অধিকন্তু, রাসূলুল্লাহ (সা.) বিভিন্ন হাদীসে বলেছেন, যদি তোমাকে নিহত হতে হয়, তাও অনেক ভালো; তবে কখনো হত্যাকারী হয়ো না। মুসলমানদের পারস্পরিক যুদ্ধ, সন্ত্রাস ও হানাহানির সময় করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, Jai, Judi ai as "এরূপ পরিস্থিতিতে মু'মিন নিহত হোক; কিন্তু সে যেন হত্যাকারী না হয়। ১৮ AS PASS "সে যেন আদাম (আ.)-এর দু সন্তানের মধ্যে উত্তম জনের (অর্থাৎ হাবিলের) মতো (নিহত) হয়। ১৯ রাসূলুল্লাহ (সা.) এসব নির্দেশনার কারণে তাঁর সাহাবীগণ হত্যাকে ভয়ঙ্করভাবে ভয় পেতেন।

ইসলামের তৃতীয় খালীফা সাইয়িদুনা 'উসমান ইবনু 'আফফান (রা.) বিদ্রোহীদের দ্বারা অবরুদ্ধ হলে সেনাবাহিনী ও সমাজের নেতৃবৃন্দ বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের ও অস্ত্রধারণের অনুমতি প্রার্থনা করেন। ইসলামী শারী'আতে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বৈধ। কিন্তু 'উসমান (রা.) বিদ্রোহীদের বুঝানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখেন, আর বিদ্রোহীরা সুযোগ পেয়ে তাঁকে হত্যা করে। উসমান (রা.)-এর মূলনীতি ছিল, আমি নিহত হতে রাজি; কিন্তু কারো রক্তের দায়িত্ব নিয়ে আল্লাহর কাছে যেতে রাজি নই। আল্লাহ তা'আলা অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা প্রসঙ্গে বলেন,

أنه من قتل نفسا بغير نفس أو فساد في الأرض فكأنما قتل الناس جميعا ومن أحياها فكأنما أحيا الناس جميعاك

কোনো মানুষকে হত্যা করার কিংবা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কাজ (করার শাস্তি বিধান) ছাড়া (অন্য কোনো কারণে) কেউ যদি কাউকে হত্যা করে, সে যেন গোটা মানবজাতিকেই হত্যা করলো। (অনুরূপভাবে) যদি কেউ একজনের প্রাণ রক্ষা করে, তবে সে যেন গোটা জাতিকেই বাঁচিয়ে দিলো।

অন্য আয়াতে তিনি বলেন,
ومن يقتل مؤمنا متعمدا فجزاؤه جهنم خالدا فيها وغضب الله عليه ولعنه وأعد له عذابا عظيما
“যে ব্যক্তি কোনো মুমিনকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করবে, তার শান্তি জাহান্নাম। সেখানে সে অনন্তকাল ধরে পড়ে থাকবে। আল্লাহ তা'আলা তার ওপর ভয়ানকভাবে রুষ্ট । তাকে তিনি লা'নাত দেন। তিনি তার জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন ।”

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, old lea“যে ব্যক্তি আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে, সে আমাদের উম্মাতের অন্তর্ভুক্ত নয়। ”২২ অন্য একটি হাদীসে তিনি বলেন, Jbuy-“কোনো মুসলমানের জন্য তার অপর ভাইকে আতঙ্কিত করা বৈধ নয়।”২৩ উপরন্তু, যে সব তরুণ আত্মঘাতী পন্থা অবলম্বন করছে, তা তো মোটেও সঠিক পথ নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে, আত্মহত্যা করা মহাপাপ এবং আত্মহত্যাকারী জাহান্নামী। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, من قتل نفسه بشيء عذبه الله به في (c) + “যে ব্যক্তি নিজেকে যে জিনিস দ্বারা হত্যা করবে, আল্লাহ তা'আলা তাকে জাহান্নামের মধ্যে সে জিনিস দ্বারাই চিরকাল ধরে শাস্তি দান করবেন।”

পবিত্র কুর'আনে বলা হয়েছে, its vie -“তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে হত্যা করো না।”২৫ নিজেকে হত্যা করার একটা স্বরূপ হলো- এই যে তরুণরা পয়লা জুলাই গুলশানের আর্টিজানে যা করলো, তারা কী বাঁচার জন্য সেখানে গিয়েছিল? তারা বস্তুতপক্ষে নিজেদের খতম করার জন্য সেখানে গিয়েছিল। ওদের শেষ করা মানে নিজে শেষ হয়ে যাওয়া- এই হলো তাদের চিন্তা। তারা বিশ্বাস করতো, 'তাদের জাহান্নামে পাঠিয়ে দেবো, আর আমরা জান্নাতে চলে যাবো'- এই চিন্তা নিয়ে তারা সেদিন তাদের হামলা পরিচালনা করেছিল। ইসলামের দৃষ্টিতে, এ চিন্তা জঘন্য ও তাদের বিকৃত মানসিকতার পরিচায়ক।

এখানে এ কথাও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ইসলামে অমুসলিমদের জানমাল ও ‘ইয্যাত-আক্রও মুসলমানদের জানমাল ও ইযযাত-আব্রুর মতোই পবিত্র। এতে অমুসলিমদেরকে হত্যা করা তো দূরের কথা; বরং তাদের সাথে অভদ্র আচরণ করতেও নিষেধ করা হয়েছে, তাদের ধর্মবিশ্বাস ও উপাস্যদেরকেও গালি দিতে বারণ করা হয়েছে। দুনিয়ার কোনো ব্যবস্থায় কার্যত এ জাতীয় সমানাধিকারের কোনো বাস্তব নজীর নেই। মুসলমানদের সিরিয়া বিজয়ের পনেরো বছর পর একজন নাম্ভরী পাদ্রী মন্তব্য করেছেন,

"এই আরব জাতি, যাদেরকে আল্লাহ তা'আলা রাজ্য প্রদান করেছেন, আমাদের মালিক হয়ে গেছে, তারা কখনো খ্রিষ্টান ধর্মের প্রতি বিরূপ আচরণ করেননি; বরং আমাদের ধর্মের হিফাযত করেন, আমাদের পাদ্রী ও মহাপুরুষগণের সম্মান করেন এবং আমাদের গির্জা ও উপাসনালয়ের জন্য আর্থিক সাহায্য প্রদান করেন।

কাজেই ইসলামী আদর্শ প্রচার ও প্রতিষ্ঠার নামে অমুসলিমদের সাথে এমন কোনো আচরণ করা বৈধ নয়, যা যুলম বা অধিকারহরণের পর্যায়ে পড়ে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,

أنا من ظلم معاهدا أو النقصة أو كلفة فوق طاقته أو أخذ منه شيئا ، نفس فأنا حجيجه يوم القيامة. بغير طيب “
যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিম নাগরিকের প্রতি অবিচার করলো কিংবা তার অধিকার ক্ষুণ্ণ করলো বা তাকে তার সাধ্যের বাইরে কষ্ট দিলো অথবা তার সন্তুষ্টি ছাড়াই কোনো কিছুই তার কাছ থেকে কেড়ে নিলো, এমন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কিয়ামাতের দিন (আল্লাহর দরবারে) আমি নিজেই ফরিয়াদী হবো। ২৭

অন্য একটি হাদীসে তিনি বলেন,
أنا من قتل نفسا معاهدا له ذمة الله ودمه رسوله فقد أخفر بدمة الله فلا يرح رائحة الجنة وإن ريحها ليوجد من مسيرة سبعين خريفا.
“যে ব্যক্তি এমন কোনো অমুসলিমকে হত্যা করবে, আল্লাহ ও রাসূল যার সুরক্ষার দায়িত্ব নিয়েছেন, প্রকারান্তরে সে আল্লাহর অধিকারই নষ্ট করেছে। এরূপ ব্যক্তি জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না।
অথচ জান্নাতের ঘ্রাণ চল্লিশ বৎসরের দূরত্ব থেকে অনুভব করা যায়।
আল্লাহ তা'আলা বলেন,

ولا يجر منكم شأن قوم على ألا تعدلوا اعدلوا هو أقرب للتقوى»
“এবং কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন কখনো তোমাদেরকে ন্যায় বিচার পরিত্যাগ করতে উদ্বুদ্ধ না করে। সুবিচার করো। এটাই তাকওয়ার অধিকতর নিকটবর্তী।"

এ আয়াতে অকাট্যভাবে এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, স্বজাতি ও বিজাতি নির্বিশেষে সবার বেলায় সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কোনো ভিন্ন জাতির ক্ষেত্রে বিদ্বেষবশত ন্যায় বিচারের বিধান লঙ্ঘন করা তাকওয়ার সম্পূ র্ণ পরিপন্থী। তাছাড়া যেখানে ইসলাম অন্য ধর্মের ধর্মযাজক ও সেবায়েত যেমন ভিক্ষু, পুরোহিত ও পাদ্রীদেরকে শত্রুদেশে যুদ্ধাবস্থায়ও হত্যা করতে নিষেধ করেছে, সেক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ অবস্থায় নিজ দেশের মধ্যে জিহাদ ও ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে প্রকাশ্যে বা গোপনে তাদের হত্যা করার প্রশ্নই তো আসতে পারে না।

মোটকথা, ইসলামের সাথে জঙ্গিবাদের কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলাম কখনোই তার আদর্শ প্রচার ও প্রসারের জন্য সহিংস পথ অবলম্বনের অনুমতি দেয় না এবং সমাজের বিজ্ঞ আলিমগণ কখনো এরূপ কাজকে সমর্থন। দেননি। তবে এটা সত্য যে, ইসলামের ইতিহাসে নানা যুদ্ধবিগ্রহ সংঘটিত হয়েছে। তবে তা হয়েছে ন্যায্য কারণে রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের অথবা রাষ্ট্রের সাথে বিদ্রোহীদের। কিন্তু মুসলিম সমাজে মুসলমানদের মধ্যে কিংবা অমুসলিমদের মধ্যে সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদের মাধ্যমে ইসলামী আদর্শ প্রচারের বা অন্য কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের উদাহরণ খুব একটা খুঁজে পাওয়া যায় না।

কাজেই প্রত্যেক মুসলিমকেই শান্তিপূর্ণ, নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক উপায়ে ইসলামের আদর্শ প্রচার ও প্রসারের কাজ করে যেতে হবে এবং এ জন্য যতদিন প্রয়োজন অপেক্ষা করতে হবে। জঙ্গিবাদী ও সন্ত্রাসী তৎপরতা দিয়ে একে তো দ্রুত ইসলামের আদর্শ প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করা যায় না, আর করা গেলেও তার কোনো শুভ ফল আশা করা যায় না। এ কথা সকলেই জানে যে, ইসলাম তার অন্তর্নিহিত স্বকীয় বৈশিষ্ট্য, সম্প্রীতি, উদারতা ও পরমতসহিষ্ণুতার মাধ্যমে পৃথিবীময় প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল; তরবারী, জঙ্গিবাদ কিংবা সন্ত্রাসের মাধ্যমে নয়। কাজেই ইসলামের দৃষ্টিতে জঙ্গিবাদ সম্পূর্ণ হারাম।

বোমাবাজি, মানুষ হত্যা, সন্ত্রাস, ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি ও আত্মঘাতী তৎপরতা ইত্যাদি ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অতএব, ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে হোক কিংবা পার্থিব-অপার্থিব কল্যাণের অলীক আশায় হোক, যে বা যারা সন্ত্রাসী-জঙ্গি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে, তারা ইসলাম, দেশ ও মানবতার শত্রু। তারা সন্ত্রাসী কর্মতৎপরতার মাধ্যমে পবিত্র ধর্ম ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহকে নানাভাবে কলঙ্কিত এবং দেশ ও জাতির বিরাট ক্ষতি সাধনে বিরাট ঘৃণ্য ভূমিকা রাখছে।

যে দল বা ব্যক্তি এগুলো করছে তারা বিভ্রান্ত, ইসলাম বিরোধীদের ক্রীড়নক। জঙ্গিরা সত্যিকার ইসলাম প্রচারক এবং ইসলামপন্থী দল ও ব্যক্তিদের বিতর্কিত করতেই এ জঙ্গিবাদকে ব্যবহার করছে। বিশ্বের সব বরেণ্য আলিম, ইসলামী চিন্তাবিদ এবং মূলধারার ইসলামী দল ও সংস্থাসমূহ সকলেই এ বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, এ ধরনের ব্যক্তিরা বিভ্রান্ত ও বিপথগামী। এরা ইসলামের শত্রুদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে। ইসলামের শত্রুরা এদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। ওরা এদেরকে ইসলামের ভাবমর্যাদা ধ্বংসের কাজে ব্যবহার করছে। তারা ইসলামকে বিশ্ববাসীর সামনে বিকৃত ও কুৎসিতভাবে উপস্থাপন করার মাধ্যমে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চায়।

উল্লেখ্য যে, মুসলিম জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো কখনো নিজস্ব স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে ইসলামের বিভিন্ন পবিত্র নাম ও পরিভাষা (যেমন- জিহাদ, খিলাফাত ও শূরা প্রভৃতি) ব্যবহার করে থাকে এবং নিজেদেরকে মুজাহিদ, আল্লাহর দল, আল্লাহর সৈনিক প্রভৃতি নামে পরিচয় দিয়ে থাকে। এদের খোঁজ-খবর নিতে হবে। অনুসন্ধান চালাতে হবে, তাদের উৎস কোথায়, তাদের উদ্দেশ্য কী? ইসলামের মূল আদর্শের সাথে তাদের কর্মতৎপরতার মিল আছে কিনা? ইসলামের প্রাথমিক কালে উবাদী খারিজীরা 'ইনিল হুকমু ইন্না লিল্লাহ' অর্থাৎ 'সকল ফায়সলার মালিক আল্লাহ তা'আলা' শ্লোগান দিয়েই বিদ্রোহ করেছিল।

তাঁরা কুরআনের কতিপয় আয়াতের অপব্যাখ্যা করে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠার নামে ইসলামের চতুর্থ খলীফা, রাসূলুল্লাহ (সা) এর প্রিয় জামাতা সাইয়িদুনা 'আলী (রা) সহ বহু সাহাবী ও তাবি'ঈকে হত্যা করেন। এমনকি সাইয়িদুনা 'আলী (রা.)-এর ঘাতক আবদুর রাহমান ইবনু মুলজিম 'আল্লাহু আকবার' বলেই তাঁকে আঘাত করেন। কাজেই কেউ যদি কপালে 'আল্লাহ আকবার' ব্যাজ লাগিয়ে কিংবা 'আল্লাহ আকবার' ধ্বনি দিয়ে সশস্ত্র অভিযান চালায়, তাতেই শুধু এ কথা মনে করার কোনোই অবকাশ নেই যে, সে আল্লাহর পথের সত্যিকার সৈনিক। সে ইসলামের নাম ব্যবহার করে ইসলামের শত্রুও হতে পারে কিংবা ইসলাম বিদ্বেষী শক্তির ক্রীড়নক হিসেবেও কাজ করতে পারে।
তারা সত্যিকার অর্থে মুসলিম নয় ।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, আমরা কয়েক দশক ধরে লক্ষ্য করছি যে, পৃথিবীর কোথাও কোনো বড় ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটলেই ঢালাওভাবে বাছবিচার না করেই সর্বপ্রথম ইসলাম ও মুসলমানদের ওপরই তার দায়ভার চাপানো হয় এবং প্রচার মাধ্যমে তা ফলাও করা হয়। অথচ পৃথিবীর ইহুদী, খ্রিষ্টান, হিন্দু ও বৌদ্ধসহ সকল জাতির মধ্যে কমবেশি সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটছে। কিন্তু অন্য ধর্মের সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাসের জন্য তাদের ধর্মকে কখনো দায়ী করা

এ জাতীয় উগ্রবাদীদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) হাদীসে বিভিন্ন ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। তন্মধ্যে একটি হলো
... قوم يقرؤون القرآن لا يجاوز حناجرهم يمرقون من الإسلام مروق السهم من الرمية يقتلون أهل الإسلام ويدعون أهل الأوثان
তারা এমন একটি সম্প্রদায়, যারা কুর'আন তিলাওয়াত করবে; কিন্তু এ কুর'আন তাদের কণ্ঠনালি অতিক্রম করবে না। তীর যেমন শিকারীর দেহ ভেদ করে বের হয়, তেমনি তারাও ইসলামের মধ্যে প্রবেশ করে আবার বেরিয়ে চলে যাবে। (অর্থাৎ তারা সত্যিকার অর্থে মুসলিম নয়।) তারা ইসলাম অনুসারীদের হত্যা করবে আর তাগুতের অনুসারীদের ছেড়ে দেবে। (বুখারী, আস-সাহীহ, হা. নং: ৬৯৯৫) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এ ভবিষ্যদ্বাণীসমূহ সর্বজনীন এবং সকল যুগেই ধর্মীয় লেবাসে ধর্মের দাবি নিয়ে এরূপ কিছু উগ্র মানুষের আবির্ভাব হতে পারে।

তবে উম্মাতের বিজ্ঞ আলিমগণ সকলেই এ বিষয়ে একমত যে, খারিজীদের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে এ ভবিষ্যদ্বাণীর প্রথম বাস্তবায়ন ঘটেছিল। উল্লেখ্য যে, খারিজীরা প্রায় সকলেই যুবক ছিলেন। এঁরা বাহ্যত অত্যন্ত ধার্মিক ও নিষ্ঠাবান আবেগপ্রবণ মুসলিম ছিলেন। সারা রাত তাহাজ্জুদ আদায় ও সারা দিন যিকর ও কুর'আন তিলাওয়াতে রত থাকার কারণে এঁরা "কুররা' বা কুর'আন পাঠকারী দল হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন।

এমনকি একান্তই ধর্মের নামে ও ধর্মের জন্য তাদের সন্ত্রাস, হত্যা ও ৩১ গণহত্যার এমন অগণিত ঘটনা রয়েছে, যেগুলোতে কখনোই তাদের ধর্মকে দায়ী করা হয় না; বরং কেবল সন্ত্রাসে লিপ্ত মানুষদেরকেই দায়ী করা হয়। কিন্তু কোনো মুসলিম সন্ত্রাস করলে তার জন্য ঢালাওভাবে ইসলামকে দায়ী করা হয়। আমরা মনে করি যে, এরূপ আচরণ ইসলামের প্রতি বিষম অন্যায়। ইহুদী, আইরিশ, সার্ব, তামিল, আসামীয়, মণিপুরী, নেপালী, চীনা, তিব্বতী, রাখাইন, আমেরিকান ও অন্যান্য সন্ত্রাসীর জন্য যেমন তাদের ধর্ম ইহুদী, খ্রিষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্ম দায়ী নয়, তেমনি মুসলিমদের সন্ত্রাসের জন্যও তাদের ধর্ম দায়ী নয়।

যদি কোনো ছাত্র চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা লাভ করে দুর্নীতি করে এবং তার এ কাজের জন্য কেউ যদি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কেই সরাসরি দায়ী করে, লোকেরা তাকে নির্বোধ ও মূর্খই মনে করবে। কারণ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতির শিক্ষা দেওয়া হয় না। বস্তুতপক্ষে তার দুর্নীতির জন্য তার ব্যক্তিগত খাহেশ ও চরিত্রই দায়ী। অনুরূপভাবে কোনো মুসলিম সন্ত্রাস করলে এর জন্য তার ব্যক্তিগত খাহেশ বা প্রতিশোধ স্পৃহাই দায়ী । এর জন্য ইসলামকে দায়ী করা সঙ্গত নয়।

কারণ, ইসলাম কাউকে সহিংসতা ও সন্ত্রাস করতে শিক্ষা দেয় না, হাঙ্গামা করতে অনুমতি দেয় না। কাজেই যে কারো অপরাধের জন্য তার ধর্মকে দায়ী করা অন্যায় তো বটেই; বরং ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, সমস্যার কারণ নির্ধারণে বিভ্রান্তি অনেক সময় সমস্যা উস্কে দিতে পারে। কথায় বলা হয়, সন্ত্রাসীর কোনো দল নেই, কোনো ধর্ম নেই। সন্ত্রাসীর পরিচয় কেবল সন্ত্রাসীই। সে কেবল তার ব্যক্তিগত খাহেশ, লোভ কিংবা প্রতিশোধস্পৃহা থেকেই সন্ত্রাসে লিপ্ত হয়। এরূপ সন্ত্রাসী ব্যক্তি কখনো নিজের সাফাই গাওয়ার জন্য, নিজের বিবেককে অপরাধ থেকে মুক্ত করার জন্য এবং অন্যান্য উদ্দেশ্যে নিজের ধর্ম ও আদর্শকে ব্যবহার করে থাকে।

কাজেই সন্ত্রাসের জন্য সন্ত্রাসীর জাতি, ধর্ম, গোত্র ও দলকে দায়ী করলে মূলত সন্ত্রাসীকে সাহায্য করা হয়। এতে একদিকে সন্ত্রাসীর জাতি, ধর্ম, গোত্র ও দলের লোকেরা সন্ত্রাসের বিরোধিতার পরিবর্তে সন্ত্রাস-বিরোধীদের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়তে পারেন। অপরদিকে পরোক্ষভাবে তাদের মধ্যে সন্ত্রাসীর প্রতি সহমর্মিতাও জন্মলাভ করতে পারে। অথচ আমরা দুঃখের সাথে লক্ষ্য করছি যে, কোনো কোনো প্রাচ্যবিদ ও তাঁদের অনুসারীগণ জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের জন্য ইসলামকে দায়ী বলে মন্তব্য করে বস্তুতপক্ষে ইসলামের সাথে পশ্চিমাদের দ্বন্দ্বকেই উসকে দিচ্ছেন।

আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, আমেরিকান, বৃটিশ, আইরিশ বা অন্য কোনো দেশের খ্রিষ্ট ধর্মের অনুসারী কোনো সন্ত্রাসীকে 'খ্রিষ্টান সন্ত্রাসী' বললে তাঁরা আহত হন এবং এরূপ বলাকে অসহিষ্ণুতা মনে করেন। কারণ, এতে ধর্মপ্রাণ সৎ খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া হয়। কিন্তু ইসলাম ধর্মের অনুসারী কোনো সন্ত্রাসীকে 'মুসলিম সন্ত্রাসী' বলতে তারা কোনো অসুবিধা মনে করেন না। তারা মনে করেন না যে, এতে ধর্মপ্রাণ সৎ মুসলিমদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে। উপরন্তু, ইসলামকে সন্ত্রাসী ধর্ম এবং মুসলিমদেরকে সন্ত্রাসী বলে আখ্যায়িত করলেও কোনোরূপ অসহিঞ্চুতা হয় বলে তারা মনে করেন না; বরং এরূপ কথার প্রতিবাদই যেন অসহিষ্ণুতা!

তদুপরি বিভিন্ন তদন্ত ও গবেষণাধর্মী রিপোর্ট থেকে জানা যায়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেসব জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড চলছে, এর পেছনে মুসলিম জনগোষ্ঠী নেই, নেই সত্যিকার ইসলাম অনুসারীরাও। এসব তৎপরতার অধিকাংশই ঘটেছে অমুসলিমদের দ্বারা। কিন্তু অনেক সময় বিনা প্রমাণে এসব সন্ত্রাসী ঘটনাকে ইসলামী জঙ্গিদের কর্মকাণ্ড বলে প্রচার করা হচ্ছে। আবার ৩৩ কখনো প্রয়োজনে বিভিন্ন দেশের ধর্মপ্রাণ যুবকদের ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহার করে তাদেরকে ডেকে এনে অস্ত্র, ট্রেনিং ও সমর্থন দিয়ে জঙ্গি তৈরি করা হচ্ছে। এরপর এ জঙ্গিবাদের অজুহাতে তাদের দেশে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

বস্তুতপক্ষে এভাবেই পশ্চিমা পরাশক্তির মদদে আন্তর্জাতিক ইহুদী চক্র মুসলিম নামে কিছু তরুণকে শিকার বানিয়ে তাদের দিয়েও কতিপয় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। একজন মুসলমানের কাছে পবিত্রতম স্থান হচ্ছে পবিত্র মাক্কা নগরীর কা'বা শরীফ এবং মাদীনা মুনাওয়ারার মাসজিদে নাবাবী। সুতরাং একজন মুসলিম কী মাসজিদে নাবাবীতে বোমা হামলা চালনার মতো ঘৃণ্য কাজ কখনো করতে পারে?! তাও আবার রামাদানের ইফতারের সময়?! আমাদের দেশের শোলাকিয়ায় সর্ববৃহৎ ঈদ জামা'আতে ঈদের নামায আদায় না করে যারা সন্ত্রাসী আক্রমণ করে মানুষ খুন করেছে তারা কোন্ যুক্তিতে মুসলিম হবে?

মূলত আইএস-এর ব্যানারে আন্তর্জাতিক ইহুদী চক্রই এসব জঙ্গি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। এ সবের উদ্দেশ্য একটাই, তা হলো- ইসলামকে জঙ্গি প্রমাণ করে এর প্রসার রোধ করা, একে অকার্যকর ধর্ম হিসেবে প্রমাণিত করা এবং মুসলিম উম্মাহর আর্থ-সামাজিক উন্নতি বাধাগ্রস্ত করা।

বলাই বাহুল্য, আন্তর্জাতিক ইহুদী চক্র মুসলমানদের বন্ধু নয়। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইহুদীদের শত্রুতা ও ষড়যন্ত্রের ইতিহাস অনেক পুরানো ও দীর্ঘ। কাজেই বর্তমানেও তারা তাদের স্বার্থে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতেই পারে। কুর'আন ও হাদীসে মুসলিমদেরকে তাদের সম্ভাব্য ষড়যন্ত্র সম্পর্কে নানাভাবে সতর্ক করা হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা বলেন, اليهود والذين أشركوا للذين آمنوا by us with scal band “অবশ্যই তোমরা লোকদের মধ্যে ঈমানদারদার সাথে শত্রুতার ব্যাপারে ইহুদী ও মুশরিকদেরই বেশি কঠোর দেখতে পাবে।

সাংস্কৃতিক জাগরণের কর্মসূচিকে তার চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টভাবে কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় আনা যেতে পারে
প্রথমত, ইতঃপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, জঙ্গিবাদের উত্থানের পেছনে বড় কারণটি হলো আধিপত্যবাদীদের নিপীড়ন, আগ্রাসন ও ষড়যন্ত্র। যতদিন এরূপ নিপীড়ন, আগ্রাসন ও ষড়যন্ত্র চলতে থাকবে, ততদিন যে কোনো দেশে কিছু মানুষ অজ্ঞতা ও আবেগের প্রেষণে উগ্রতায় লিপ্ত হয়ে যেতে পারেন। এরূপ সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এ কারণটির নিরসন বা নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই আমাদের আওতার বাইরে। তবে আমাদের পক্ষে যেটা করা সম্ভব তা হলো, আমাদের জাতীয় রাজনীতিকরা ফিলিস্তিন নিয়ে পশ্চিমাদের কূটকচাল এবং আফগানিস্তান ইরাক-লিবিয়া-সিরিয়া প্রভৃতি মুসলিম দেশে তাদের হস্তক্ষেপের ভ্রান্ত রাজনীতির উচ্চ কণ্ঠে সমালোচনা করতে পারেন। এটি ক্ষুব্ধ তরুণদের রাজনৈতিক ইস্যু বা সংকটকে ধর্ম দিয়ে মোকাবিলার ভ্রান্তি থেকে মুক্ত করে জঙ্গিবাদের পরিবর্তে রাজনৈতিক ভূমিকা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করবে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির ভাষ্যকারেরা অনেকবার মন্তব্য করেছেন, 'ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান হলে পৃথিবীর ৯০ শতাংশ সন্ত্রাসের অবসান ঘটবে।'

বাংলাদেশের জঙ্গিবাদ আন্তর্জাতিক পরিসরের সম্প্রসারণ বৈ নয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক এলিটরা জঙ্গিবাদের নির্মূল চাইবেন, আবার আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের তল্পি বহন করবেন- এ দ্বৈতনীতি সমস্যার স্থায়ী সমাধান বয়ে আনতে পারে না।

দ্বিতীয়ত, জঙ্গিবাদের উত্থানের পেছনে আরেকটি প্রধান কারণ হলো যুবকদের বেকারত্ব, বঞ্চনা ও হতাশা। আমাদের সমাজে যেসব যুবক জঙ্গি তৎপরতায় লিপ্ত, তাদের প্রায় সকলের জীবনেই আমরা কমবেশি এ বিষয়গুলো দেখতে পাই। (তবে অধুনা ধনাঢ্য পরিবারের কতিপয় যুবককেও এরূপ সহিংসতায় লিপ্ত হতে দেখা যায়।) বেকার, বঞ্চিত ও হতাশাগ্রস্ত যুবকদেরকে হয়তো কেউ এরূপ কথা বুঝিয়ে থাকে, এরূপ সহিংসতার মাধ্যমে অতি দ্রুত তোমাদের ও অন্যদের কষ্ট ও বঞ্চনার সমাপ্তি ঘটবে এবং ইসলামী খিলাফাত প্রতিষ্ঠা হবে।

তোমরা কর্ম ও ক্ষমতা অথবা জান্নাত লাভ করবে। বঞ্চিত, বেকার ও হতাশ যুবকরা সহজেই এ কথা বিশ্বাস করে সহিংসতায় লিপ্ত হয়। কারণ, তাদের অন্য কোনো কর্ম নেই এবং তাদের পাওয়ার আশার বিপরীতে হারানোর তেমন কিছুই নেই। কাজেই জঙ্গি সঙ্কটের স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে আমাদেরকে সমাজের সকলের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও মুক্তির জন্য কাজ করে যেতে হবে।

উল্লেখ্য যে, সকল মুসলিম দেশে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকলেও জঙ্গিবাদী কার্যক্রম সকল দেশেই সমানভাবে বিস্তার লাভ করেনি। ইন্দোনেশিয়ায় যেরূপ সন্ত্রাসী কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায়, মালয়েশিয়াতে তা দেখা যায় না, অথচ ইসলামী শিক্ষার বিস্তার, মাদ্রাসার সংখ্যাধিক্য এবং আমেরিকা ও পাশ্চাত্য বিরোধী মনোভাব মালয়েশিয়াতে বেশি। এর বড় কারণ, সম্ভবত মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং পশ্চিমাদের আগ্রাসন ও মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে শাসক এলিটদের সুস্পষ্ট মত। একদিকে কর্মব্যস্ত বা পরিতৃপ্ত মানুষের মনে ক্ষোভ বা আবেগ বেশি স্থান পায় না, অপরদিকে শাসক এলিটদের বক্তব্যে যদি তাদের মনের আবেগ প্রতিধ্বনিত হয়, তাহলে তা প্রকাশের জন্য বিকৃত পথের সন্ধান করে না।

তৃতীয়ত, আমাদের ব্যক্তি, পরিবারও সমাজে নৈতিকতার প্রশিক্ষণের চরম ঘাটতি রয়েছে। মায়ের কোলই সন্তানের প্রথম স্কুল। তাই পরিবারে নারীদেরকে আদর্শ মা ও সুশিক্ষিতা হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। নেপোলিয়ান বোনাপার্ট যথার্থই বলেছেন, “Give me an educated mother, I shall promise you the birth of a civilized, educated nation.” মিসরের জাতীয় কবি হাফিয ইব্রাহীম চমৎকার বলেছেন,
الأم مدرسة إذا أعددتها ... أعددت شعبا طيب الأعراق

“মা হলো একটি স্কুল। যদি তুমি তাকে সযত্নে গড়ে তুলতে পারো, তাহলে তুমি এক মহান ও পবিত্র জাতিই তৈরি করলে!”

তদুপরি সন্তানদের প্রতি পিতামাতা ও অভিভাবকদের তত্ত্বাবধান ও তদারকি বাড়াতে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সম্প্রতি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পিতামাতাকে সন্তানদের ধর্মীয় শিক্ষা দেয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আমরা তাঁর এ আহ্বানকে অভিনন্দন জানাই। বলাই বাহুল্য, সন্তানরা যদি ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা না পায়, তাহলে যে কোনো সময় স্বার্থান্বেষী মহল কর্তৃক তাদের মগজ ধোলাইয়ের শিকার হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

চতুর্থত, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়ও নৈতিকতার প্রশিক্ষণের অবস্থা সন্তোষজনক নয়। বলাই বাহুল্য, যে শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রাধান্য থাকে না, সে শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত ও দক্ষ লোক হওয়া যায় বটে; কিন্তু ভালো ও আদর্শ মানুষ হওয়া যায় না। উল্লেখ্য যে, আমেরিকাতে নিগ্রোরা খুব বেশি অপরাধপ্রবণ। তারা অতি মাত্রায় সন্ত্রাস করে। এ জন্য নিগ্রোদের কিছু বুদ্ধিজীবী দীর্ঘদিন গবেষণা করে সুপারিশ করেন যে, যদি সত্যিকার অর্থে নিগ্রো জাতিকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হয়, তাহলে তাদেরকে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। এ কথা সকলেই স্বীকার করে যে, পাশ্চাত্যের দেশগুলো অনেক উন্নত।

জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এসব ক্ষেত্রে তাদের কোনো জুড়ি নেই। কিন্তু তার পরেও তারা সমস্যা অনুধাবন করছেন। তাদের সমস্যা হলো নৈতিকতার সমস্যা। তারা শিক্ষিত ও দক্ষ লোক তৈরি করছে বটে; কিন্তু নৈতিকতাসম্পন্ন লোক তৈরি করতে পারছে না। এজন্য পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে এখন আন্ডারগ্র্যাজুয়েট লেভেল এবং গ্র্যাজুয়েট লেভেলে তারা এথিকস পড়াচ্ছে। তারা তাদের ধর্ম সম্বন্ধে যেহেতু যথেষ্ট উৎসাহী নয়, তাই এ কারণে তারা ধর্মের কথাগুলোই এথিকসের নাম দিয়ে পড়ানোর চেষ্টা করছে। কাজেই দেশের প্রত্যেক নাগরিক যাতে সৎ ও চরিত্রবান এবং সুস্থ চিন্তা ও বিশুদ্ধ বিশ্বাসের অধিকারী ব্যক্তি হিসেবে গড়ে ওঠে, তাই ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণ করতে হবে

পঞ্চমত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম এমন সুনিবিড়ভাবে পরিচালনা করতে হবে, যাতে ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে কেউ শিক্ষা কার্যক্রম ব্যতীত অন্য কোনো বিষয়ের সাথে জড়িত হবার সুযোগ না পায়। এ লক্ষ্যে ছাত্র-শিক্ষকদের ক্লাসে নিয়মিত উপস্থিতি সুনিশ্চিত করতে হবে এবং সিলেবাস, কারিকুলাম ও পরীক্ষাপদ্ধতি প্রভৃতি সময় ও অবস্থার দাবি অনুযায়ী আরো উন্নত ও দৃঢ় করতে হবে।

ষষ্ঠত, সমাজকে সেবা ও কল্যাণের পথে এবং সুস্থ ও রুচিশীল বিনোদনের মাধ্যমে মানবিক করে তোলার জন্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক জাগরণের উদ্যোগ নিতে হবে।

সপ্তমত, যাতে জঙ্গিরা রাজনৈতিক কোনো আশ্রয় বা সুবিধা অর্জন করতে না পারে, তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে পরস্পরের প্রতি সহিষ্ণু ও উদার আচরণ করতে হবে। রাজনৈতিক বিভেদ ও অস্থিতিশীলতা এবং সামাজিক বৈষম্য বাড়তে থাকলে অবস্থার সুযোগ নিয়ে জঙ্গিরা বেড়ে ওঠতে পারে এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর সাথে দেশীয় জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর সম্পর্ক শক্তিশালী হতে পারে। কাজেই এ সঙ্কট থেকে উত্তরণে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও সামাজিক সুবিচারের মান আরো উন্নত করতে হবে।

অষ্টমত, জঙ্গিদের জন্য, বিশেষ করে আজও যারা হত্যা বা অনুরূপ অপরাধে জড়িত হয়নি তাদের জন্য সমাজের মূলধারায় ফিরে আসার সুযোগ উন্মুক্ত রাখতে হবে। তারা যদিও জঘন্য অপরাধী; কিন্তু মনে রাখতে হবে, তাদের অপরাধের পেছনে মূল কারণ হলো- তাদের বিকৃত চিন্তা ও ধর্মীয় উন্মাদনা ।। তাদের পরিচয় যতখানি না অপরাধী হিসেবে, তার চেয়ে বেশি পরিচয় হচ্ছে তারা এক একজন ধর্মীয় উন্মাদ ও বিকৃত মস্তিষ্ক হিসেবে।

কাজেই . তাদেরকে যদি নিরুৎসাহিত করা হয় এবং সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়া যায়, তাহলে আশা করা যায় যে, তাদের চিন্তার এ ভ্রান্তি ও উন্মাদনা নিরসন হবে এবং তারা সমাজের মূলধারায় ফিরে আসবে।
উল্লেখ্য যে, বেকারত্ব, সামাজিক বৈষম্য, বঞ্চনা ও অজ্ঞতা দূর না করে কেবল শক্তি বা আইন দিয়ে কঠোর হস্তে জঙ্গি নির্মূলের চেষ্টা করা হলে হয়তো অনেক জঙ্গি নির্মূল হবে; কিন্তু এ সঙ্কটের স্থায়ী সমাধান আশা করা যায় না।

কাজেই তাদেরকে দেশের শত্রু বিবেচনা করে যতটুকু নির্মূল করার চিন্তা করতে হবে, তার চেয়ে দেশের নাগরিক ও সন্তান বিবেচনা করে যথাসম্ভব সংশোধন করে সমাজের মূলধারায় সংযুক্ত করার চিন্তা করতে হবে বেশি। এতদুদ্দেশ্যে এরূপ তরুণদের সংশোধনের জন্য চেষ্টা জোরদার করতে হবে। কারণ, জঙ্গিদের সামনে সমাজের মূলধারায় ফিরে আসার কোনো সুযোগ না থাকলে তারা আরো বেপরোয়া হয়ে যেতে পারে।

নবমত, সমাজে মানবিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ব্যাপক চর্চা ও বিকাশ সাধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে 'আলিম, মাসজিদের ইমাম, খতীব, ওয়ায়িয ও পীর-মাশারিখগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। এজন্য তাদেরকে আরো বেশি দায়িত্ব সচেতন ও সক্রিয় করতে হবে। তাঁদেরকে এ কথা বুঝতে হবে যে, জঙ্গিবাদে যেহেতু ইসলামের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে এবং এর মাধ্যমে একে একটি অকার্যকর ধর্ম হিসেবে প্রমাণিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে, তাই এর প্রকৃত স্বরূপ উদ্ঘাটনে 'আলিম ও ইমামগণের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি।

জঙ্গিবাদের জন্য পশ্চিমাদের অপরাজনীতি ও ইসলামের শত্রুদেরকে দায়ী করে বক্তব্য দিলেই তাদের সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। জঙ্গিদের সকলকেই অমুসলিমদের ক্রীড়নক মনে করারও কোনো কারণ নেই। এদের মধ্যে অনেকেই এমনও থাকতে পারে যে, যারা ধর্মীয় আবেগ নিয়ে সাওয়াব ও নাজাত লাভের উদ্দেশ্যে উগ্রতা, সহিংসতা ও খুন-খারাবিতে লিপ্ত হচ্ছে। এদেরকে সঠিক জ্ঞান প্রদান ও বিভ্রান্তি অপনোদনের দায়িত্ব 'আলিম সমাজের। তাঁরা প্রত্যেক মুসলিমের মর্মমূলে এ কথা প্রোথিত করে দিতে চেষ্টা চালাবেন যে, ইসলাম জবরদস্তি, সহিংসতা, খুন করা সমর্থন করে না; মানুষ হত্যা করে ইসলামের বিস্তার কিংবা ভাবমর্যাদা রক্ষা করা যায় না; এসব অনৈতিক কার্যকলাপ বরঞ্চ ইসলামের ইমেজকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

উল্লেখ্য যে, কারো যদি সঠিক ইসলামী জ্ঞান থাকে, তাহলে তাকে ইসলামের নামে বিভ্রান্ত করা সম্ভব হয় না। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুসারে যতগুলো জঙ্গি দলের তালিকা করা হয়েছে, যত জঙ্গি গ্রেফতার করা হয়েছে বা তালিকাভুক্ত করা হয়েছে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার দিকে একবার তাকালেই যে কেউ জানতে পারবেন যে, এদের অধিকাংশই আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। উপরন্তু, এদের অধিকাংশই আলিমগণের ঘোর বিরোধী। তারা আলিমদেরকে আপোষকামী ও অজ্ঞ বলে প্রচার করে এবং তাদের অনুসারীদেরকে আলিমদের সাথে মিশতে বারণ করে।

শুধু তাদের মতের সাথে যে সব আলিমের মত মিলে যায়, তারা শুধু তাদেরই প্রশংসা করে। এদের ধর্মীয় আবেগের সাথে সঠিক ধর্মীয় জ্ঞান না থাকার কারণে এদের মধ্যে উগ্রতা জন্ম নিয়েছে। বলাই বাহুল্য, ধর্মের প্রতি মানুষের যে অনুভূতি তা সন্তানের প্রতি স্নেহ, পিতামাতার প্রতি ভালোবাসা ও সম্পদের প্রতি মোহ প্রভৃতির মতোই সহজাত ও জন্মগত। এ অনুভূতিকে নির্মূল করা যায় না এবং নির্মূলের প্রচেষ্টা বুমেরাং হয়। একে সঠিক খাতে প্রবাহিত করাই মানবতার কল্যাণের একমাত্র পথ। কাজেই কারো মধ্যে ইসলামের প্রতি আবেগ ও ভালোবাসার পাশাপাশি ইসলামের সঠিক জ্ঞান না থাকলে তাকে সহজেই বিভ্রান্ত করা সম্ভব। এ কারণে সমাজে ইসলামের সঠিক জ্ঞানের চর্চা বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

অধুনা আমরা লক্ষ্য করছি যে, কতিপয় বুদ্ধিজীবী ধর্ম ও ধর্মানুসারীদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে জঙ্গিবাদ দমনের কথা বলছেন। এতদুদ্দেশ্যে তাদের কেউ কেউ ইসলামী শিক্ষা বন্ধ কিংবা সঙ্কোচনের ব্যবস্থাপত্রও দিয়ে থাকেন এবং ইসলাম অনুসারীদের (যেমন- দাড়িওয়ালা, টুপিওয়ালা, বুরকাপরিহিতা, মাসজিদগামী দীনদার কর্মকর্তা, কর্মচারী ও ছাত্র-শিক্ষক প্রভৃতি) প্রতি ঘৃণাও প্রকাশ করে থাকেন। আমরা মনে করি যে, হয়তো তাঁরা সমাজের লোকদের চিন্তা-বিশ্বাস সম্পর্কে মোটেও অভিজ্ঞ নন কিংবা ধর্মের প্রতি বিদ্বেষবশত এরূপ ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছেন।

যেখানে সমাজের সিংহভাগ লোকের অস্থিমজ্জার সাথে ধর্মীয় বিশ্বাসের সম্পর্ক, সেক্ষেত্রে ধর্ম ও ধর্মানুসারীদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে সমস্যার সমাধান খুঁজতে চাওয়া কী সমাজহিতৈষী জ্ঞানী লোকের কাজ হতে পারে?! এরূপ ব্যবস্থাপত্র নিঃসন্দেহে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত; সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ নয়। পৃথিবীর বহু মুসলিম দেশে অনেক শাসকই ধর্ম ও ধর্মানুসারীদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে অবস্থার পরিবর্তন ও উন্নতি ঘটাতে চেয়েছিলেন; কিন্তু তাদের সে প্রচেষ্টা কোথাও সফল হয়নি। এ ক্ষেত্রে আমরা তুরস্কের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে পারি।

এ দেশটিতে দীর্ঘদিন ধরে শাসকগোষ্ঠী ধর্ম ও ধর্মানুসারীদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে অবস্থার পরিবর্তন ও উন্নতি ঘটাতে চেয়েছিল; কিন্তু পরিণাম ভালো ও সুখকর হয়নি। কাজেই ধর্ম ও ধর্মানুসারীদের সাথে সম্পর্ক ঠিক রেখে কীভাবে জঙ্গিবাদ ও চরমপন্থা মোকাবিলা করা যায় এবং এ কাজে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষাকে কীভাবে আরো সফলভাবে প্রয়োগ করা যায়- তা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। আশার কথা হলো, বর্তমানে বিশ্বের মুসলিম দেশের শাসকগণ এ কথা বুঝতে শুরু করেছেন যে, বর্তমান সঙ্কট থেকে উত্তরণ পেতে হলে সমাজে ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ সাধন করতে হবে এবং এ কাজে উলামা-মাশা য়িখের সম্পৃক্ততা আরো বাড়াতে হবে।

ধর্মকে অবহেলা কিংবা অবজ্ঞা করে বর্তমান সঙ্কটের সমাধান করতে চেষ্টা করা হলে তাতে সঙ্কট দূরীভূত হওয়ার চেয়ে গভীরতর ও স্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আমরা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই, তিনি তাঁর জঙ্গি বিরোধী বিভিন্ন ভাষণে এ সঙ্কট উত্তরণে উলামা-মাশারিখকে দৃঢ় ভূমিকা রাখতে এগিয়ে আসার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।

উল্লেখ্য যে, চরমপন্থী ও জঙ্গিরা যে সকল মতাদর্শ ও দাবি-দাওয়া প্রচার করে থাকে, প্রায় একইরূপ মতাদর্শ ও দাবি-দাওয়া প্রচার করেন ইসলামের মূলধারার আলিম, শিক্ষাবিদ ও পীর-মাশায়িখ। পার্থক্য হলো কর্মপদ্ধতিতে । চরমপন্থী ও জঙ্গিরা বলপ্রয়োগ, আইন অমান্য ও খুন-খারাবির মাধ্যমে তাদের আদর্শ চাপিয়ে দিতে চায়। পক্ষান্তরে মূলধারার ইসলামপন্থীরা দেশের আইনের আওতায় গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যে নিজেদের বক্তব্য পেশ করে থাকেন। গ্রহণ করা বা না করা জনগণের ইচ্ছাধীন।

যেমন মাওবাদী সন্ত্রাসীরা বা আমাদের দেশের চরমপন্থী বলে কথিত 'বামপন্থী জঙ্গিরা' যে মতাদর্শ ও দাবি-দাওয়া প্রচার করে, মূলধারার মার্কসবাদী, সাম্যবাদী, সমাজতন্ত্রী বা বামপন্থীগণও সে একই মতাদর্শ ও দাবি-দাওয়া প্রচার করে থাকেন। সাম্যবাদী জঙ্গি বা সমাজতন্ত্রী সন্ত্রাসীদের কারণে কেউ মূলধারার সাম্যবাদী বা সমাজতন্ত্রীদেরকে দায়ী করেন না বা চরমপন্থা দমনের নামে বামপন্থী রাজনীতি ও কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করার দাবি তোলেন না। কেউ বলেন না যে, 'সাম্যবাদী রাজনীতির কারণেই চরমপন্থী ও সন্ত্রাসীর জন্ম নিচ্ছে, কাজেই সাম্যবাদী রাজনীতি বন্ধ করা হোক।' কিন্তু ইসলামের ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ণ বিপরীত দেখা যায়।

জঙ্গিবাদ দমনের অজুহাতে অনেক সময় ইসলামী আদর্শ, শিক্ষা ও মূল্যবোধ বিকাশের দাবি বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়। অথচ গণতন্ত্রের একটি দাবি হলো, সকল দল ও মতের মানুষকেই তার মত ও আদর্শ প্রচারের সুযোগ দেওয়া। গ্রহণ করা না করা। জনগণের ইখতিয়ার। গণতান্ত্রিক অধিকারের আওতায় মত প্রকাশের অধিকার দিলে উগ্রতার পথ রুদ্ধ হয়। বস্তুত গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এক দল আরেক দলের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করতেই পারেন। যারা ইসলামী মূল্যবোধ, শিক্ষা ও আচার-আচরণকে 'প্রতিক্রিয়াশীলতা', 'পশ্চাদপদতা' বা উন্নয়নের প্রতিবন্ধক বলে বিশ্বাস করেন অথবা তাদের বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যবাদী বা অনুরূপ স্বার্থের প্রতিবন্ধক বলে মনে করেন, তারা জঙ্গিবাদের অজুহাতে ইসলামী শিক্ষা ও মূল্যবোধ বিস্তারের সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার দাবি করতেই পারেন।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা তাদেরও অবশ্যই আছে। তবে সরকার ও প্রশাসনকে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে। তাঁদের নিজস্ব কোনো মত বা পক্ষ থাকলেও সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর তাঁদের একান্ত কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়, সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা, দেশের স্বার্থ সমুন্নত রাখা এবং ক্ষমতার চেয়ে দেশ ও জনগণের স্থায়ী কল্যাণ সাধনের পরিকল্পনা নেয়া। আমাদের বোঝা দরকার, ভালো-মন্দ কোনো কথারই কন্ঠ রোধ করার প্রবণতা কখনো সুফল বয়ে আনে না। বিশেষত জঙ্গিবাদের অজুহাতে ইসলামী আদর্শ প্রচার ও শিক্ষা বিস্তারের আইনসম্মত দাওয়াতকে নিষিদ্ধ বা বাধাগ্রস্ত করা হলে তা নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হরণের অপরাধ ছাড়াও দেশ ও জাতির জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। এ জাতীয় যে কোনো পদক্ষেপ জঙ্গিদেরকে সাহায্য করতে পারে এবং তাদের প্রচারণা জোরদার করতে পারে।

দশমত, জঙ্গি দমনের নামে যেন কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি কোনোরূপ শাস্তি ও হয়রানির সম্মুখীন না হয়, সে দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে। শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে নিরপরাধ ছাত্র-শিক্ষক ও ধার্মিক ব্যক্তিকে আটক করা, নির্যাতন করা, কারাগারে অন্তরীণ রাখা ও রিমান্ডে নেওয়া ইত্যাদি কর্ম একদিকে মানবাধিকারকে ভূলুণ্ঠিত করবে, অপরদিকে তা এ সকল নিরপরাধ ব্যক্তি ও তাদের আত্মীয়স্বজনকে জঙ্গিবাদের প্রতি আকৃষ্ট করে তুলবে এবং সর্বোপরি তা আমাদেরকে আল্লাহর গযব ও শাস্তির মধ্যে নিপতিত করবে। কারণ, নিরপরাধদের শাস্তি, হত্যা ও কষ্টদান যখন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক রূপ পরিগ্রহ করে, তখন আল্লাহর গযব ও জাগতিক শাস্তি সে দেশের ভালো-মন্দ সকল মানুষকেই গ্রাস করে।

আল্লাহ তা'আলা আমাদের জাতি ও সরকারকে জঙ্গিবাদ নির্মূলের লক্ষ্যে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করার এবং একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও নিরাপদ দেশ গড়ে তোলার তাওফীক দান করুন! আমীন!!

وأخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين، وصلى الله وسلم على نبينا محمد وعلى آله وصحه احمين.
Tags

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Ok, Go it!
close