এক টুকরো রোদ (নাসের রহমান) - ১

Mofizur Rahman
0

এক টুকরো রোদ (নাসের রহমান) - ১

এক টুকরো রোদ (নাসের রহমান) - ১

এক টুকরো রোদ

ভোর হতে না হতে তারিনের ঘুম ভেঙে যায়। রাতের আঁধারকে ধীরে ধীরে মুছে দিতে দিতে প্রভাত পাখির কণ্ঠে যেন সুর আর সঙ্গীতের মূর্ছনা তোলে। সেই সমবেত গান সবাইকে জাগিয়ে তোলে, কাউকে ঘুমিয়ে থাকতে দেয়না, একে একে সবাই চোখ মেলে কিন্তু কেউ বিছানা ছাড়ে না। অনেকদিন পর তারিনের এভাবে শুয়ে শুয়ে পাখির ডাক শুনতে বেশ ভালো লাগে । সে কান পেতে থাকে, বুঝতে চেষ্টা করে কোনটা কোন পাখির ডাক। কিন্তু পারে না, ঘুম জাগানো পাখিরা যেন আজ সমবেত কণ্ঠে দেশের গান গেয়ে চলছে এই মুহুর্তে কন্ঠ চেনা বড় কঠিন ।

পেছনের কৃষ্ণচূড়া গাছটির শাখায় কত রকমের নাম জানা-অজানা পাখি এসে বসে ঠিক নেই। কখনো জোড়ায় জোড়ায় কখনো একাকী আবার কখনো দল বেঁধে এসে ডানা জেকে বসে। ঘুঘু দম্পতি কখনো ঘন্টার পর ঘন্টা পাশাপশি নিঃশব্দে বসে থাকে। কি যেন ধ্যানে মগ্ন জোড় পাখির তামাটে বর্ণের চোখ দু'টি সাদা ভেতর থেকে বড় বড় পাখা মেলে জানালার পাশে এসে মাথা উঁচু করে ডাকে । তারিন বালিশ থেকে মাথা তুলে বাইরে দৃষ্টি দেয় দুধাল গাভীর ওলান থেকে দোহন করা দুধের সাদা ফেনার মত চারিদিকের বাতাস যেন আজ রুপালী চাদরে জড়িয়ে আছে।

ভোরের কুয়াশার কোমল সাদা কাশফুলের মত ভেসে ভেসে পাতায় পাতায় পরশ মেখে দিচ্ছে। তারিন ভেবে কুল পায় না আজকের সকাল কেন এত বিভোর করছে তাকে। পাশে ছোট্ট বাবুটি কাত হয়ে কেমন করে ঘুমাচ্ছে। আহা তারেককে যদি সকালের কোমল এইরুপ একবার দেখাতে পারতো । সেতো কখনো প্রকৃতির অবয়ব বদলানোর এমন দৃশ্য দেখে না তার ঘুম ভাঙতে ভাঙতে সূর্য অনেক উপরে উঠে যায়। সূর্য অবশ্য দেখা যায়। না, অনুমান করা যায় মাত্র। সেখানে ঘড়ির কাঁটা দেখে দিন আর রাতের সময় ধরা হয় সকালের আলসেভাব সে সহজে কাটাতে পারে না।

রাত করে ঘুমাতে যাওয়া তার দীর্ঘদিনের স্বভাব। সকালে উঠতে চাইলেও সহজে ঘুমের রেশটা কাটতে পারে না। তাল মেলে না যেন সবকিছুর সাথে, সারা দিনটাতে ঘুমের অপূর্ণ এক নেশা যেন লেগে থাকে। সূর্যটা দেখার জন্য মাঝে মাঝে মনটা অস্থির হয়ে যায়। সূর্য তো দূরের কথা, এক টুকরো রোদও ঘরের কোন জায়গায় এসে পড়ে না তারিন প্রথম এসে খুব মুগ্ধ হয় এপার্টমেন্টের আধুনিকতা দেখে । বেড রুমটি বড় চমৎকার সাথের বাথরুমটিও। ঘরের আসবাবপত্র থেকে শুরু করে সংসারের যাবতীয় খুটিনাটি সবকিছু একের পর এক তারিন সাজিয়ে নিলো।

এমনকি ওয়াল পেইন্টিং কোথায় লাগালে বেশী মানানসই হবে তাও সে চিন্তা ভাবনা করে টাঙ্গালো । ফুল আর পাতা ভর্তি দু'টি টব নিয়ে এসে তারেক একদিন বললো তোমার ফুল আর গাছ প্রীতি আপাততঃ একটু কমবে, দেখ কি এনেছি । তারিন প্রথমে কোন মন্তব্য করলো না, কিছুক্ষন তাকিয়ে বললো, বেশ সুন্দরতো; হাত দিয়ে ছুঁয়ে না দেখলে সহজে কেউ বলতে পারবে না এটা প্রানহীন উদ্ভিদ; আসলেও উদ্ভিদও নয় জড় বস্তু ।

বেশ কয়েকমাস ঘোরের ভেতর কেটে যায়। ফ্যানের বাতাস ছাড়া বাইর থেকে আলো বাতাস ঢোকার জো নেই। দিনের বেলায়ও বাতি জ্বালিয়ে রাখতে হয় ।বাইরে তাকানোর কোন সুযোগ নেই। জানালার পর্দা সরালেও আলোর কোন হেরফের হয় না। চারদিকের উঁচু উঁচু দালানের পয়ঃপ্রনালীর মোটা মোটা পাইপগুলো চোখের উপর ভেসে উঠে। তারেক অফিসে চলে যাওয়ার পর বাসায় তেমন কাজ থাকে না । রেকর্ড প্লেয়ারে গান শুনতে শুনতে ঘর গোছানো কিংবা পাক্ষিক পত্রিকায় চোখ বুলানো ছাড়া আর কিবা করার আছে? সকাল বেলায় টেলিভিশন খুলতে ইচ্ছা করে না।

এসময়টাতে প্রায় সবাই ব্যস্ত থাকে নানা কাজকর্মে । তারিন নিজেকেও ব্যস্ত রাখতে চায় কিন্তু কোন পথ খুঁজে পায় না। আগে কবিতার বই পড়তে বেশ লাগতো, এখনও মাঝে মধ্যে পড়ে, বিকেলে; তবে আগের মত মন বসাতে পারে না। সকালেও কয়েকবার হাতে নিয়ে নাড়াচড়া করে, পাতার পর পাতা উল্টায় কিন্তু কোথাও দৃষ্টি স্থির করতে পারে না। ফুল পাখি আর প্রজাপতির সাথে সখ্যতা ছাড়া আর তেমন কোন স্মৃতি নেই যা চোখের ওপর ভাসাতে পারে কিন্তু প্রকৃতির এসবের কোন কিছুই দেখা যায় না। এসবের স্পর্শ পেতে হলে যেতে হয় অনেক দূরে।

এত সময় কই তারেকের হাতে? প্রায়দিন অফিস থেকে ফিরতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায়। গাছ আর নদীর সাথে যে মানুষের বন্ধুত্ব হতে পারে তা কখনো বুঝানো গেল না। সে সরাসরি জওয়াব দিয়ে বলে, নদীর গান কিংবা গাছের কথা কবিরাই বুঝতে পারে । আমরা এসব ভাবলে মাথাটাই গোলমাল হয়ে যেতে পারে। কবিরা এসব ভেবে লিখতে পারে, তাই তাদের ভাবনা মাথা থেকে বের হয়ে যায় । তারিন শুনে মন্তব্য করে, তুমি এখন দেখছি বেশ যুক্তি দিয়ে কথা বলতে পারো


আমি বাস্তববাদী মানুষ, বাস্তবতায় আমার বিশ্বাস। ভাবের সাথে কোন সময়ে আমার কোন সম্পর্ক ছিল না, ভবিষ্যতেও থাকবে না। ভাব নেই যে এমন কোন মানুষ নেই, সবার মাঝে কিছু না কিছু ভাব আছে, তা কখনো জাগে আবার কখনো লুকিয়ে থাকে। আমার ভাব চিরদিনই সুপ্ত থাকে তারিনের রাতটা ভালো কাটে, তারেক সাথে থাকে। কখনো কখনো বিকেলটাও দু'জন একসাথে ঘুরে আসে কোথাও, পার্কে কিংবা রেস্তোরায়। তারিন রেস্তোরায় তেমন একটা যেতে চায় না, বলে তার চেয়ে অনেক ভালো কোন নির্জন জায়গায় গিয়ে দু'জন পাশাপাশি বসে থাকি।

এই ব্যস্ত নগরীতে কোথায় নির্জন জায়গা খুঁজে পাবে। যেখানে যাও সেখানে লোকজনের দেখা হয়ে যাবে। আছে এক বোটানিক্যাল গার্ডেন; সেতো অনেক দূর, সময় নিয়ে যেতে হয় ।

তারেকের আবার লোকলজ্জা একটু বেশী, কারো কাছে সে সহজে মনের কথা খুলে বলতে পারে না। হেটে যাওয়ার স্বভাবটা তার মাঝে নেই। সহজে কারো সাথে মিশতেও পারে না। ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলতে তার তেমন কেউ নেই । মাঝে মধ্যে ঘুরতে বের হলে নতুবা মার্কেটে গেলে কারো সাথে দেখা হয়ে যায়। 'কেমন আছ, কোথায় আছ এখন, তোমার বউ নাকি?' এরকম মাপা মাপা ছেড়া ছেড়া দু'একটি বাক্য ছাড়া আর তেমন কথা হয় না। তারিনের কাছে কেমন যেন লাগে ।

কখনো কখনো বলে ফেলে, তুমি একেবারে আনসোশাল, ক্লাসমেট বলছো অথচ কথাবার্তায় কোন আন্তরিকতা নেই। তারেক সংক্ষিপ্ত জওয়াবে বলে, তুমি ওসব বুঝবে না । ছাত্রজীবন আর কর্মজীবনের মধ্যে অনেক পার্থক্য । এখানে কেউ টিকে থাকার আপ্রান চেষ্টা করে চলছে আবার কেউ বড় হওয়ার অসম প্রতিযোগীতায় নেমেছে। টাকার নেশায় দিন আর রাত এক হয়ে গেছে । তারিন শুনে জানতে চায়, তুমি কোন দিকে?

কোন পক্ষে নই, আমি একজন সুখী মানুষ হতে চাই । এবং সুখ আর স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে যতটুকু টাকার প্রয়োজন ততটুকু হলে চলে। এখন কেমন আছো বলে মনে হয়? বেশ ভালো আছি। আমার এই বয়সে সৎপথে থেকে আর মাত্র ছয় বৎসর পর একটি এপটিমেন্টের মালিক হয়ে যাওয়া কি সহজ কথা? আর তোমার মত এমন সুন্দরী স্ত্রী যার পাশে থাকে তার ভালো না থেকে কোন উপায় আছে?

তারিন তখন মনে মনে তৃপ্তির হাসি হাসে । প্রথম দিকে কেমন যেন সবখানে তাল মেলাতে পারতো না। মফস্বল শহর থেকে এসে হঠাৎ করে মহানগরীর ব্যস্ত জীবনের সাথে নিজেকে সামলে নেওয়া অনেকটা ভাবনার বিষয় ছিল । কিন্তু বিয়ের কয়েকমাসের মধ্যে সে ব্যস্ততা কেটে যায়। একেবারে ঘরের বউ হয়ে নির্দিষ্ট ছকে আটকে পড়ে। যেন জীবন বলতে এইটুকু, এই গন্ডির বাইরে আর কোথাও কোন প্রয়োজন নেই অবশ্য সংসারে বাবু আসার পর, সময় যে কিভাবে চলে যায় টেরও পায় না সে।

বিয়ের আগে প্রতিদিন কতজনের সাথে দেখা হতো, পরিবার প্রতিবেশী, পরিচিত অনেকের সাথে দেখা হলে বিরক্ত লাগতো, একটু একা থাকার সুযোগ খুঁজতে হতো। আর কলেজের সময়টুকু যে কোন ফাঁকে হারিয়ে গেলে টেরও পাওয়া যায়নি। কমনরুমে মেয়েদের হৈ চৈ লেগে থাকতো সারাক্ষন। ক্লাশ না থাকলে কলেজের পুকুর পাড়ে গিয়ে আড্ডা জমাতো সবাই কয়েকজন ছেলে আশেপাশে ঘুর ঘুর করতো, মেয়েদের কথার সাথে তাল মেলাতে চাইতো ।

অন্য ছেলেরা কেন এদেরকে লেসু বলতো এখনো তারিন ভেবে পায় না। সবুজ নামের একটি ছেলে তারিনের কাছে নববর্ষের একটি কার্ড ডাকযোগে পাঠিয়েছিল। কেন পাঠিয়েছিল তার অর্থ এখনো খুঁজে পায় না সে। ছেলেটি চুপচাপ স্বভাবের ছিল, কারো সাথে কথাবার্তা তেমন বলতো না। কখনো তার সাথে কলেজের কোন মেয়ের কথা হয়েছে কিনা তাও সে মনে করতে পারে না।

তারেকের সাথে এসব গল্প কখনো জমে উঠে না। কেন যেন সে শুনতে শুনতে হু হা শব্দ করে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। তারিন ঘুম থেকে জাগাতে চেষ্টা করলে বলে, অতীত সবসময় অতীত, অতীত নিয়ে নাড়াচাড়া করলে শুধু পুরানো জঞ্জাল বাড়ে, তার চেয়ে ভবিষ্যত নিয়ে ভাব, দেখবে লাভ হবে তারিন বিরক্ত হয়ে বলে, সবকিছুতে তুমি লাভ লোকসানের হিসাব কর, তোমার শৈশব কৈশোরের কোন স্মৃতি মনে পড়ে না?

পড়ে পড়ে, আমার এত স্মৃতি জমা আছে তুমি শুনলে অবাক হয়ে যাবে, তাই বলি না। আর এসব শুনেও কোন কাজ নেই, কেউ এসবের শেয়ার নেয় না। সবাই নিজেরটার সাথে হিসাব মেলাতে চায়, তাই নিজের স্মৃতি নিজের কাছে প্রিয়, অন্যের কাছে অর্থহীন। তোমার সাথে আমি যুক্তিতে পারব না।

তাহলে লক্ষী মেয়ের মতো চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ো। ঘুম ভাঙলে দেখবে সুন্দর এক সকাল।
তোমার কথা আমি বুঝতে পারলাম না । আমি কি না বুঝার মতো কিছু বলেছি? সকাল আর বিকেলের পার্থক্য তোমার এখানে বুঝা যায় না। সময়তো তোমাকে ঘড়ি দেখেই বুঝতে হবে সময় না, আমি বলছি বেলা, সকাল দুপুর আর সন্ধ্যা বেলা; যা সূর্য দেখে বলা এই যে বললে সকাল দুপুর বুঝা যায় না। বুঝা যায়, তবে ঘড়ি দেখে আর কি যায়। যখন সূর্য দেখা যায় না? তখন অনুমান করে বলতে হয় বেশ অভিজ্ঞদের মতো কথা বলছো দেখছি।

কলেজের লেখাপড়া শেষ করলাম, বিয়ে হলো তোমার সাথে সংসার শুরু করলাম, সস্তান আসলো তারপরও কি আনাড়ি থেকে যাব? কথার বেশ খৈ ফুটছে দেখি আজ । সত্যি বলতে কি তোমার এই বাসাটা একদম ভালো লাগে না এখন ।
কেন এই বাসায় তোমার এত অসুবিধা কিসের?

আমার অসুবিধার কথা বাদ দাও। বাবুর কথা একবার ভেবে দেখেছো? তারেক কোন কথা না বলে তারিনের দিকে তাকায় । একটু রোদ কিংবা বাইরের একটু বাতাসের জন্য সে কেমন উন্মুখ হয়ে থাকে দেখনা সব বাচ্চারা ওরকম খোলা-মেলা জায়গার কথা বলছি না। বাচ্চাদের শরীরে প্রতিদিন একটু রোদ, একটু বাইরের হাওয়া লাগা খুব দরকার । তুমিতো এখন ডাক্তারের মত কথা বলছো দেখছি। এতে ডাক্তারীর কি দেখলে?

শরীর এবং মন সতেজ রাখতে হলে প্রকৃতির সাথে মিশতে হয় । জান প্রকৃতিই সকল প্রানীর প্রকৃত শিক্ষক । তুমি ডিগ্রী পাশ করে যতটুকু জান আমি মাষ্টার্স করেও ততটুকু জানিনা ।। এসব হালকা করে দেখার বিষয় না। হালকা করে দেখছি কই । সন্তানের ভবিষ্যতের ব্যাপার না? কিন্তু প্রশ্ন হলো এ ঘর ছাড়লেতো এরকম আরেকটা ঐ টাকায় পাওয়া যাবে না। আমি কি তোমাকে তাই বলছি ।

তাহলে কি করতে হবে, রোদের জন্য হয় বাচ্চাকে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়াতে হবে। আর নির্মল বাতাসের জন্য মাঠে ঘাটে ঘুরতে হবে। তারিনের আর কথা বলতে ইচ্ছে হয় না। এই মুহুর্তে কবি সুকান্তের সূর্যের প্রতি প্রার্থনার কথা মনে পড়ে, রাতের হাড় কাঁপানো শীতের কষ্টে অসহায় লেংটা ছেলেটি রাস্তার পাশে রোদের জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকার দৃশ্যটি ভেসে উঠে।

তারিনের নিঃশব্দতা দেখে তারেক জিজ্ঞেস করে, তোমার কি মন খারাপ করেছে ? বাড়ির পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছটি দেখতে পাও না বলে, নাকি ফুল আর পাতার ফাঁকে রোদ কিংবা জোৎস্নার আলোর সান্নিধ্য পাচ্ছ না বলে । তারিন ভারী কণ্ঠে বলে, আমার মন খারাপ করা কোন ব্যাপার নয়, বাবু এই পরিবেশে বড় হলে প্রকৃতির এতসব সৌন্দর্য উপভোগ করার মত মানসিকতা তার তৈরী হবে না । তুমি শুধু শুধু মন খারাপ করতেছো এসব কার না ভালো লাগে? সবাই প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়। কেউ প্রকাশ করতে পারে আবার কেউ পারে না ।

এত বুঝ, কেবল আমরা দু'জনেরটা বুঝ না বল, কি করলে তুমি খুশি হবে?
আমরা দু'জন মাস খানেকের জন্য বাড়ি থেকে ঘুরে আসি একমাস। এত দীর্ঘ সময় আমি একা থাকবো কি করে? বাঃরে; আমিতো প্রায় এক বৎসর পর যাচ্ছি। আর বাবুর প্রথম যাওয়া আবেদন মঞ্জুর করা হলো তবে আমি একবার গিয়ে দিয়ে আসবো আবার গিয়ে নিয়ে আসবো, মাঝামাঝি আর যেতে পারবো না।
না গিয়ে থাকতে পারলে ভালো। কেন তোমার সন্দেহ হয়?
আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে। কিন্তু তোমার বাবুকে না দেখে থাকতে পারবে? পারব, মানুষ সব পারে। যাক আর ওসব কথায় কাজ নেই। দেখনা বাবু তুলতুলে গালে আঙ্গুলের কোমল ছোঁয়া দিতে থাকে । তারিন বলে, একেবারে তোমার মত হয়েছে ।

নাক আর চোখ দু'টি যেন হুবহু তোমার কার্বন কপি । রংটা কিন্তু আমার পেয়েছে । তারেক চোখের ভাষায় জওয়াব দিয়ে তারিনের নাকটা চেপে দিয়ে বলে, এটা তোমার মত হলে বেশী খুশি হতে তাই না? তারিন লজ্জা পেয়ে বলে, তুমি কি যে বল বুঝি না।

একটু কম বুঝা ভালো। তাহলে বেশি বেশি সুখী হওয়া যায়। তখন হটাৎ বাবু জেগে যায় । চোখ দু'টি খোলে বড় বড় করে তাকিয়ে ক্ষুদে হাত দু'খানি উপরের দিকে তুলে দেয়। তারেক দু'হাত চুমুতে চুমুতে ভরে দেয়। তারিন বসে বসে আপ্লুত নয়নে তাকায়।

পূর্বাকাশে সূর্যের লাল রংয়ের ভেতর চারিদিকের সাদা ভাবটা মিলিয়ে যায়। দেখতে দেখতে রক্তলাল সূর্যটি ঝলমল উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে দেয়। সবটুকু লাল যেন উজ্জ্বলতার তীব্রতায় লুকিয়ে যায়, চোখের দৃষ্টি ফিরে আসে নিজের সীমানায় । ঘাস আর পাতায় পাতায় রাতের আঁধারে ঝরে পড়া শিশির কণা বিন্দু বিন্দু তারা হয়ে জ্বলতে থাকে। কুয়াশাসিক্ত ফুলেরা আলোর স্পর্শে পাপড়ি মেলতে মেলতে সব সৌরভ যেন বাতাসে বিলিয়ে দেয়। পাখিরা ঘুম জাগানোর গান ছেড়ে খাবারের খোঁজে ডানা মেলে উড়ে কাঁচা সোনা রোদে।

বাবু আজ ঘুম থেকে উঠছেনা সহজে। ভোরের আগে একবার জেগেছে, তারিন বুকে টেনে নিতে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। রাতে ঠান্ডা পড়ে এখন, ছোট কম্বলটি বেশ কয়েকবার টেনে দিয়েছে গায়ের ওপর। সে বার বার সরিয়ে দিতে চেয়েছে। এখনও ছোট্ট একটি হাত কম্বলের বাইরে আদর জড়িয়ে পড়ে আছে । তারিন হটাৎ মুগ্ধ নয়নে তাকায় এক টুকরো রোদ রাজ হাসের পালক ছুঁয়ে জানালার ফাঁকে বাবুর ছোট্ট হাতটিতে যেন চুমু খাচ্ছে। সে জানালার একটি কপাট পুরো খুলে দেয়। সাথে সাথে এক ফালি রোদ বিছানায় এসে লুটিপুটি খেতে খেতে বাবুর মুখখানি আলোকিত করে তোলে।

ঘুমের ভেতর রোদেও কোমল স্পর্শে আত্মজের অসম্ভব সুন্দর মুখখানিতে অপূর্ব হাসির রেখা খেলা করে যায়। এমন হাসি আর কখনো দেখেনি তারিন, সে অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে। তখন রাঁজহাস দু'টি জানা ঝাপটিয়ে উচ্চস্বরে ডেকে উঠে; অন্য পাখিরাও সুর মিলিয়ে ডাকতে শুরু করে। শিশিরসিক্ত ফুলের পাপড়িরা প্রজাপতির ডানার মত করে রোদ আর ভোরের বাতাসের অবিরল ধারায় জানালার ভেতর দিয়ে যেন জন্ম উৎসবে মেতে উঠে। ধীরে ধীরে নতুন অতিথির চোখের পাতা সূর্যের আলো আর অজস্র ফুলের পাপড়ির ছোঁয়ায় খুলে যেতে থাকে। তখন পাখিদের মত শিশুটিও চেনা স্বরে আপন ভাষায় গাইতে থাকে।

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Ok, Go it!
close