স্বপ্ন ও শোকার্ত ফুলের আর্তনাদ (এক টুকরো রোদ) - ৬

Mofizur Rahman
0

স্বপ্ন ও শোকার্ত ফুলের আর্তনাদ (এক টুকরো রোদ) - ৬

স্বপ্ন ও শোকার্ত ফুলের আর্তনাদ (এক টুকরো রোদ) - ৬

স্বপ্ন ও শোকার্ত ফুলের আর্তনাদ

মাসুদ ভার্সিটি এসে বিপাকে পড়ে যায়। সেলিম ভাইয়ের ঠিকানা নিয়ে সে হলে আসে। ঠিকানা খুঁজে পেতে খুব একটা বেড় পেতে হয় না কিন্তু সাক্ষাত পেতে বেশ সময় লেগে যায়। রাত এগারটা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরও দেখা মেলে না । ক্লান্তি ও ঘুম এমনভাবে আচ্ছন্ন করে সে আর থাকতে পারে না। কয়েকবার ঢলে ঢলে পড়েও যায় বিছানায়। সেলিমের রুমমেট টের পেয়ে শুয়ে যেতে বলে। মাসুদকে সে আড়ষ্ঠতার ভেতর থেকে জানতে চায়, সেলিম ভাই কোথায় গেছেন? রুমমেট পড়ার টেবিল থেকে ঘাড় ফিরিয়ে মাসুদের দিকে তাকায়।

ছেলেটি কি সেলিম ভাই সম্পর্কে কিছু জানে না? নাকি এসব খবর এখনও গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছেনি? গ্রামের ছেলে দু'বৎসর কলেজে পড়েছে অথচ একেবারে গ্রামীণ রয়ে গেছে।

রুমমেট বইয়ের পাতায় দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে মাসুদের প্রশ্নের জবাব দেয়। সেলিমভাই খুব ব্যস্ত মানুষ, কখন কোথায় যায় ঠিক বলা যায় না।
মাসুদ একটু অবাক হয়ে বলে, এত ব্যস্ততা কিসের? রুমমেট কিছুটা বিরক্ত হয় ছেলেটির কথায়, সেলিম ভাই সংগঠন করেন, এই হলের দায়িত্বে আছেন।

মাসুদ আশ্চর্য হয়ে বলে হলের দায়িত্বে আছে ।
এসবতো তোমার জানার দরকার নেই, রাত অনেক হয়েছে, তুমি শুয়ে পড়ো। মাসুদ আর কথা বাড়ায় না, শুয়ে পড়ে। কয়েক মিনিটের মধ্যে তার চোখ জুড়ে ঘুম নেমে আসে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে রুমমেট গভীর ঘুমের ভেতর ডুবে আছে। আর কেউ নেই, দরজা আটকানো হয়নি। সে বাইরে এসে বারান্দায় দাঁড়ায়। এক ধরনের উঠানের মত খোলা বারান্দা; সে আর দেখেনি। লাল ইটের বিশাল দালানটিতে কোথাও সিমেন্টের আবরণ দেখা যায় না। পাহাড়ের কোলে মাথা রেখে যেন শুয়ে আছে। সূর্য উঠছে মাত্র। কাঁচা সোনা রোদ পশ্চিমের উঁচু পাহাড় ছুঁয়ে রুমের সামনে এসে পড়েছে।

আশে পাশের রুমের দরজা বন্ধ, দু'একজন ছাত্র বারান্দার ওয়ালে বনে দাঁত ব্রাশ করছে। সবুজ ঘাস আর লতা-পাতার ভেতর থেকে ভোরের কোমল আলোর ছোঁয়ায় পাহাড়টিও যেন ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। নীচের সাজানো বাগানের ফুলেরা সকালের স্নিগ্ধ বাতাস পাপড়িতে জড়িয়ে সূর্যের দিকে মুখ করে আছে। মাসুদ এমনিতেই ভোরে ঘুম থেকে উঠে যায়। সকালের সতেজ বাতাসটা খুব ভালো লাগে। বাড়ির উঠানে হাঁটে কিছুক্ষণ, পুকুর ঘাটে গিয়ে দাঁড়ায় অনেক সময়, দীঘির শান্ত জলে রোদের ছায়ার ভেতর পুরো গ্রামটি যেন সে দেখতে পায় । এখন এই ভিন্ন পরিবেশেও ভালো লাগছে তার আশে-পাশের লোকজন, গাছ-গাছালি সবই অপরিচিত তবুও যেন দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে।

ধীরে ধীরে সূর্য উপরের দিকে উঠে। রুমের দরজা খুলতে থাকে একের পর এক। ছাত্রদের অনেকে দাঁত ব্রাশ করতে করতে বারান্দায় পায়চারী করে। কেউ আবার বাথরুমের প্যাসেজে অপেক্ষা করে। এতক্ষণের শান্ত পরিবেশটা ক্রমশঃ রোদের আলোতে যেন মিলিয়ে যায়। মাসুদের দিকে তেমন কেউ তাকায় না, সে কমবেশি প্রায় সবার দিকে তাকাতে চেষ্টা করে। বারান্দায় ছেলেদের আসা যাওয়া বেড়ে যায়, তার নিজের কাছে সংকোচ বোধ হয় । সে আর দাঁড়িয়ে না থেকে রুমে ঢুকে যায় ।

রুমমেট ফ্যাকালটিতে যাওয়ার সময় মাসুদকে সাথে নিয়ে যায়। আর্টস ফ্যাকালটির সামনে লাইব্রেরী ভবনের কাছে মাসুদ বাস থেকে নেমে পড়ে। লাইব্রেরীর সিঁড়ি বেয়ে কয়েক ধাপ উপরে উঠে আবার থেমে যায়। ফ্যাকালটির দিকে মুখ করে তাকিয়ে থাকে। এত বিশাল ভবন সে আর কখনো দেখেনি । পাহাড় জুড়ে সুউচ্চ ইমারত তাক লাগিয়ে দেয়। এত উঁচু শহীদ মিনার সে কোথাও দেখেনি । বাসে করে আসার সময় মিনার শৃঙ্গের চিমনিটি সে মাথা কাত করে জানালা দিয়ে দেখে। এতবড় কাঁচের চিমনি কেন বসিয়েছে তার অর্থ খুঁজে পায় না সে।

রাতে জ্বলে কিনা পাশের জনকে জিজ্ঞেস করতে সাহস হয়নি। তবে চিমনির ভেতর বাঘের মত কি একটা দেখা যায়। দিনের রোদের আলোতে চিমনিটা ঝলমল করে । মাসুদ ফ্যাকালটির মাঠে স্মৃতিচিহ্ন দেখে কিছুটা ভাবনায় পড়ে যায়। বিমূর্ত রূপটি কিছুতেই মাথায় আনতে পারে না। রাস্তার পাশ ধরে আর মাঠের কিনারা ঘেষে বেড়ে উঠা গাছের রঙিন ফুলেরা সবুজ পাতাদের জড়িয়ে রেখেছে। যেন লাল হলুদ আর বেগুনি রঙের বন্যায় রোদটাকে আলোকময় করে সারা ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে দিয়েছে।

মাসুদদের পাড়াগাঁয়ে পুকুর পাড়ে বিলের ধারে ঝোপ-ঝাড়, গাছ-গাছালি, লতা পাতায় কত বিচিত্র বর্ণের ফুলের মেলা বসে কিন্তু কখনো এই ফুলের মত এত সুন্দর টকটকে মনে হয়নি। মৌসুমী ফুলেরা সবসময় চোখের সামনে থাকে অথচ কোনদিন এভাবে দৃষ্টি স্থির রাখতে পারেনি। একই রকমের ফুল, তবুও কেন এক জায়গার ফুল থেকে অন্য জায়গার ফুলের সৌন্দর্য এত আলাদা, মাসুদ বুঝে উঠতে পারে না।

লাইব্রেরীর সিঁড়ি বেয়ে এক সিনিয়র ছাত্রকে উঠতে দেখে মাসুদ জানতে চায় প্রথম বর্ষ অনার্সের ভর্তি ফরম কোথায় পাওয়া যায় । সিনিয়র জিজ্ঞেস করে, তুমি কোন ইউনিটের ফরম নিতে চাও? মাসুদের ইউনিট সম্পর্কে তেমন ধারনা নেই। সে নিজের ইচ্ছার কথা জানিয়ে বলে, আমি আর্টস থেকে পাশ করেছি, অর্থনীতি পড়তে চাই। সিনিয়র প্রশাসনিক ভবনের দিকে দেখিয়ে বলে, ঐ বিল্ডিং এর নীচ তলায় 'খ' ইউনিটের ফরম দিচ্ছে । সিনিয়রের মুখের দিকে আবার তাকায় সে। সিনিয়র স্মিত হেসে বলে, ইকনোমিক্স 'খ' ইউনিটে।

মাসুদ ভবনটির কাছে এসে দেখে লম্বা লাইন। সবার পেছনের জনকে জিজ্ঞেস করে, এটা কি 'খ' ইউনিটের লাইন? হ্যাঁ সূচক জওয়াব পেয়ে আবারও নিশ্চিত হতে চায় অর্থনীতির ফরম কি এখানে? ভর্তিচ্ছু ছাত্রটি ভর্তির গাইড খুলে 'খ' ইউনিটের সবক'টি বিষয়ের নাম পড়ে শুনায়। লাইনে দাঁড়িয়ে মাসুদও অনেকক্ষণ পর্যন্ত গাইডের পাতা উল্টিয়ে দেখে । লাইনের আশে-পাশের আরো কয়েক জনের সাথে আলাপ পরিচয় হয়। ভর্তির ব্যাপারেও কথাবার্তা হয়।

মাসুদ ওদের কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে পারে। ফরম নিয়ে সামনের যে ক'জন বেরিয়ে আসে তাদের থেকে সিরিয়াল চলে গেছে হাজারেরও বেশি। লাইনের ছাত্ররা ধীরে ধীরে এগোয় কিন্তু পেছনে আরো লম্বা হতে থাকে।

ফ্যাকালটির বাইর থেকে মিছিলের আওয়াজ কানে আসে। শ্লোগানের শব্দগুলি। স্পষ্ট বুঝা যায় না । কিছুক্ষণের মধ্যে ফ্যাকালটির ভেতর থেকে আরেকটি মিছিল। শ্লোগান দিতে দিতে বাইরের পুরাতন লাইব্রেরীর দিকে যায়। শ্লোগানের শব্দগুলো এখনও বুঝা যায় না। কিন্তু আওয়াজ ক্রমাগত বেড়ে চলছে। সমবেত উচ্চ কন্ঠের চিৎকারের মত ফ্যাকালটির উঁচু দেওয়াল পার হয়ে যেন পাহাড়ের চূড়া স্পর্শ করছে। কিছুক্ষনের মধ্যে মুখরিত ভাবটা আর থাকে না।

মিছিল থেকে উত্তেজনার হাওয়া আশে পাশে ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রদের অনেকে গন্ডগোলের আশংকা করে। আবার কেউ কেউ ভয়হীন কণ্ঠে বলে, এসব ঘটনা ভার্সিটিতে সবসময় ঘটে, এর মধ্যে যে যার কাজ করে যায়।

লাইন এগোতে থাকে মাসুদ একেবারে সামনে চলে আসে। পেছনের চাপটা এখনও আছে মিছিলের উত্তেজনা আরও বেড়ে যায় শ্লোগান থেকে পাল্টা শ্লোগান মিছিল দু'টিকে মুখামুখি করে তোলে। রোদটা আরো তীব্র হয়ে উঠে । উত্তেজনাও রোদের সাথে পাল্লা দিয়ে টান টান হয়ে যায়। হটাৎ হৈ চৈ এর শব্দ শোনা যায়। ধর ধর শব্দ করে কয়েকজনকে পেছন থেকে ধাওয়া করে।

মাসুদের লাইনটি ভেঙে যায়। পর পর কয়েকটি ককটেলের শব্দ হয়। মিছিল দু'টি ছত্রভংগ হয়ে পড়ে। ছাত্ররা এদিক সেদিক ছুটতে শুরু করে। অফিসের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। মাসুদ কথা বলারও সুযোগ পায় না। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে দেখে বিল্ডিং এর ওপাশ থেকে কয়েকজন তরুন এগিয়ে আসছে। তাদের হাতে অস্ত্র । সে কোন দিকে পালাবে বুঝে উঠতে পারে না । এভাবে দিনের বেলায় ছাত্রদের অস্ত্র হাতে সে আর কখনো দেখেনি। অবাক হয়ে কয়েক মুহুর্ত দাঁড়িয়ে থাকে। পরক্ষনেই দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে না ভেবে সামনের দিকে দৌড়ে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়।

লাইব্রেরীর সামনে আরেকটি দল রাইফেল উঁচিয়ে অপেক্ষা করছে। সে ডানে নাকি বামে যাবে স্থির করতে পারে না। ছত্রভঙ্গ মিছিলের জঙ্গী ছাত্ররা বিক্ষিপ্ত ভাবে দূরে দাঁড়িয়ে আছে। মাসুদ তাদের মাঝে হটাৎ সেলিমভাইকে দেখতে পেয়ে ওদিকে ছুটে যায়। তখন গুলির শব্দ শুনে সে দাঁড়িয়ে যায়। পেছনের দিকে ফিরে তাকায় । পর পর অনেকগুলি গুলির শব্দ হয়। দু'পক্ষের মধ্যে শুরু হয় গুলি বিনিময়। কয়েক মিনিটের মধ্যে গুলির শব্দে ক্যাম্পাসটি রণক্ষেত্র হয়ে উঠে।

মাসুদ ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। দিক বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সে। ঝড়ের দিনে মেঘ থেকে শিলা বৃষ্টি যেভাবে ঝরে পড়ে তেমনি বন্দুক রাইফেলের গুলিরা ছুটে যায় তার এপাশ ওপাশ দিয়ে। রোদের তীব্রতাকে ভেদ করে বিজলি চমকের মত ক্ষণে ক্ষণে অগ্নি স্ফুলিঙ্গ তার দু'চোখ যেন ঝলসে দেয়। হঠাৎ সেই স্ফুলিঙ্গ তার বুক বিদীর্ণ করে সূর্যের হাজারো লেলিহান শিখায় জ্বলে উঠে । সেলিম ভাই বলে চিৎকার করে লুটিয়ে পড়ে তপ্ত মাটিতে। তার আর্তনাদ গুলির শব্দকে থামিয়ে দেয়। সেলিমভাই দু'হাত উচিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে আসে। তার ভেতরটা কেঁপে উঠে।

আহা, কাসেম চাচার ছেলে মাসুদ। কয়মাস আগে বাড়ি যাওয়ার পথে বিলের ধারে দেখা । বাপের সাথে জমি চাষ দিতে ছিল আমাকে দেখে হাল ছেড়ে দৌড়ে এসে বলেছিল, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাই।

সেলিম ভাইকে দেখে অস্ত্রধারীরা ক্রমাগত পেছনের দিকে সরতে থাকে। দুপুরের কাঠফাটা রোদের তেজ আর বাড়ে না, স্থির হয়ে যায়। পাখিদের সব গান করুণ কান্না হয়ে মাসুদের আর্তনাদের ভেতর হারিয়ে যায়। পাহাড়ের আদিম নিস্তব্ধতায় যেন চারিদিক ডুবে যায়। মাসুদের লাল রক্ত বুক বেয়ে তপ্ত মাটিতে পড়ার আগে আগুন হয়ে কৃষ্ণচূড়ার সাথে মিশে যায়। তখন আশে পাশের হলুদ আর বেগুনি ফুলেরা পাপড়ি মেলে শোকার্ত নয়নে দাঁড়িয়ে থাকে।

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Ok, Go it!
close