কেন ব্রিকসে যোগদান দেশের জন্য লাভজনক - Why joining BRICS is beneficial for the country

Mofizur Rahman
0

কেন ব্রিকসে যোগদান দেশের জন্য লাভজনক - Why joining BRICS is beneficial for the country

কেন ব্রিকসে যোগদান দেশের জন্য লাভজনক - Why joining BRICS is beneficial for the country

  • কেন ব্রিকসে যোগদান দেশের জন্য লাভজনক ফারাজী আজমল হোসেন

ব্রিকসে যোগদান দেশের জন্য লাভজনক কি?

এক অস্থির অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব। যেখানে জ্বালানির মূল্য থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক বাজারে লেনদেন হওয়া ডলার মূল্য ভোগাচ্ছে অধিকাংশ দেশকে। এই সমস্যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। সেইসঙ্গে যুক্ত হয়েছে নির্বাচন-পূর্ববর্তী রাজনৈতিক ডামাডোল । কিন্তু এসব কিছুকে পাশ কাটিয়ে উঠে আসছে ব্রিকসে বাংলাদেশে যোগদানের বিষয়টি। প্রশ্ন হলো, কেন ব্রিকসে বাংলাদেশে যোগদানকে কেন্দ্র করে আশাবাদী হয়ে উঠেছেন দেশের কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ এবং অর্থনীতিবিদরা?

বাংলাদেশের জন্মলগ্নেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঠিক করে দিয়েছেন দেশের পররাষ্ট্রনীতি। এই নীতির মূল বক্তব্যই হচ্ছে ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ । বৰ্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বের নীতিতেই আস্থাশীল । দেশের অগ্রগতিই তার কাছে সবচেয়ে জরুরি। তাই উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রেখে বাংলাদেশকে ‘সোনার বাংলা' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছেন তিনি।

ব্রিকস গোষ্ঠীতে যোগদান সেদিক থেকে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বার্থেই ব্রিকসে যোগদান সময়ের দাবি। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও ব্রিকস তার সদস্য সংখ্যা বাড়াতে চাইছে। বাংলাদেশকে ইতিমধ্যেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সেই আমন্ত্রণে ইতিবাচক সাড়াও মিলেছে ঢাকা থেকে ।

কিন্তু দেশের যে কোনো উন্নয়নের বিরোধী বিএনপি ব্রিকসে বাংলাদেশের যোগদানের বিরোধিতা শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু কেন তারা বিরোধিতা করছে? কার স্বার্থে? বাংলাদেশের স্বার্থে, নিজ দলের স্বার্থে, নাকি তাদের কোনো প্রভুর স্বার্থে? বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে। কেননা বাংলাদেশের স্বার্থবিরুদ্ধ দাবি তুলে তো আর বাংলাদেশের ক্ষমতায় থাকা যাবে না!

আগামী ২২ থেকে ২৫ আগস্ট দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ব্রিকসের ১৫তম শীর্ষ সম্মেলন। এই সম্মেলনেই বাংলাদেশের সদস্যপদ চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের ব্রিকসে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। ব্রিকসে যোগদান শুধু দেশের অর্থনীতির উন্নয়নই নয়, ভূরাজনীতিতেও নতুন মেরুকরণে অংশীদার হবে বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্রিকস জোটে যোগ দিলে বাংলাদেশে ক্ষতির কিছু নেই। বরং পুরোটাই লাভজনক হতে চলেছে।

বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশের শক্তি আরও বাড়বে। ব্রিকস জোটে যোগ দিলে গোটা দুনিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান আরও সুদৃঢ় হবে। ব্রিকস জোটভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভবিষ্যতে বিকল্প মুদ্রা বা বিকল্প বাণিজ্যিক ব্যবস্থা চালু হলে বাংলাদেশ এক্ষেত্রেও বাড়তি সুবিধা নিতে পারবে । ভবিষ্যতে ব্রিকস আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলে তা থেকে বড় আকারের ঋত সুবিধাও পাবে বাংলাদেশ।

ব্রিকস এখন আর শুধু পাঁচটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। এর ব্যাপ্তি বাড়ছে। নতুন নতুন সদস্য যোগ দিলে পৃথিবীর প্রায় ২৮ শতাংশ ভূখণ্ডে ব্যাপ্তি হবে ব্রিকসের। গোটা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ মানুষ চলে আসবে এই জোটের অধীনে। ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো সম্মিলিতভাবে বিশ্বের ২৫ শতাংশ জ্বালানি তেল ও ইস্পাত তৈরি এবং ৫০ শতাংশ আকরিক লোহা উৎপাদন করে থাকে। 

কৃষিক্ষেত্রে বিশ্বের ৪০ শতাংশ ভুট্টা এবং ৪৬ শতাংশ গম এ জোটভুক্ত দেশগুলোর প্রস্তাবিত এলাকায় উৎপন্ন হয় ৷ বিশ্ব বাণিজ্যে তাদের অবদান ১৮ শতাংশ। বিশ্বের সাত ধনী দেশের ফোরাম জি-সেভেনভুক্ত দেশগুলোর বৈশ্বিক জিডিপি বা মোট দেশজ উৎপাদন ৩০ শতাংশের বিপরীতে ব্রিকসের দেশগুলোর দখলে আছে সাড়ে ৩১ শতাংশ।

একটি প্রক্ষেপণে অনুমান করা হয়, ২০৩০ সালের মধ্যে ব্রিকস দেশগুলো বৈশ্বিক জিডিপিতে ৫০ শতাংশের বেশি অবদান রাখবে । ফলে এই গোষ্ঠী দ্রুত শক্তিশালী হয়ে উঠছে।

দক্ষিণ আফ্রিকার এই গোষ্ঠীর রাষ্ট্রদূত অনিল সুকলাল জানিয়েছেন, ‘ব্রিকসের বিস্তার নিয়ে আলোচনা চলছে। এখনো পর্যন্ত ১৩টি দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেয়ার কথা বলেছে এবং ছয়টি দেশ আগ্রহ প্রকাশ করেছে । ব্রিকসে যোগ দেয়ার বিষয়ে প্রতিদিনই চিঠি পাচ্ছি আমরা।'

জুন মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসারের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকের পরই বাংলাদেশের ব্রিকসে যোগদানের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তখনই জেনেভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বাংলাদেশের ব্রিকসে যোগদানের বিষয়ে ইঙ্গিত দেন। তিনি জানিয়েছিলেন, ব্রিকসে যোগদানের জন্য বাংলাদেশের কাছে আমন্ত্রণ রয়েছে।


সৌদি আরব, ইরান, আর্জেন্টিনা, আলজেরিয়া, মিশর, বাহারাইন, ইন্দোনেশিয়া, সিরিয়া, পূর্ব ও পশ্চিম আফ্রিকার একটি করে দেশ কসে যোগ দিতে পারে। বাংলাদেশের যোগদানের বিষয়টি অনেকটাই নিশ্চিত।

ব্রিকসে যোগ দিলে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের দরজা আরও প্রশস্ত হবে। বহু দেশ সহজেই আকৃষ্ট হবে বাংলাদেশে শিল্প স্থাপনে। বৈদেশিক বাণিজ্যেও জোয়ার আসবে। বিদেশি মুদ্রার ক্ষেত্রেও লাভবান হবে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক স্তরে বাংলাদেশের মর্যাদাও অনেকটা বেড়ে যাবে। বৈশ্বিক রাজনীতিতে দেশের সম্মান বৃদ্ধির স্বার্থেই ব্রিকসে যোগদানের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য যথার্থ। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকছে ব্রিকসের সদস্যপদ গ্রহণের মাধ্যমে।

আমাদের সততার সঙ্গে মূল্যায়ন করতে হবে যে আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ব্রিকসের অংশ হওয়ার ফলে কীভাবে উপকৃত হতে পারে। সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের জাতীয় স্বার্থে সুবিধাজনক চুক্তির সম্ভাবনাও থাকছে ব্রিকসের মাধ্যমে। তাই ব্রিকসকে কাজে লাগিয়ে দেশের অগ্রগতির পথ আরও প্রশস্ত করতে সরকারের এই উদ্যোগকে সমর্থন করাটাই জরুরি।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অবশ্য ব্রিকসের সমালোচনা করছেন। সরকারের বিরোধিতা করার নামে তিনি দেশের উন্নয়নের বিপক্ষে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে তুলেছেন। ব্রিকস প্রসঙ্গে ফখরুল বলেছেন, 'বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি মনে করে ব্রিকসে বাংলাদেশের যোগদান একটি সুবিধাবাদী পদক্ষেপ। আওয়ামী লীগ যখন দেখল পশ্চিমা বিশ্ব তাদের গ্রহণ করছে না, তখন তারা ব্রিকসে যোগদানের জন্য আলোচনা শুরু করে।

তার এই বক্তব্যের সঙ্গে চলমান ভূরাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই । আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরোধিতা করার জন্যই তিনি এমন মন্তব্য করেছেন, তা বেশ স্পষ্ট। বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বার্থেই ব্রিকসে যোগদান জরুরি। তা ছাড়া ব্রিকসের তরফ থেকেই বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে সদস্যপদ গ্রহণের জন্য। আর শুধু বাংলাদেশ একা নয়, বিশ্বের বহু দেশ ব্রিকসে যোগ দিচ্ছে।

বৈশ্বিক টালমাটাল অবস্থাকে সামলে নিতে ১৯টি দেশ জোটে যোগ দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে ব্রিকসবিষয়ক বিশেষ দূত অনিল সুকলালের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ। বিবিসির মতে, ব্রিকস আরও সম্প্রসারিত হলে অর্থনীতির নতুন দিগন্ত উন্মোচনের সম্ভাবনা রয়েছে। পশ্চিমা গণমাধ্যমও চাইছে বাংলাদেশ যোগ দিক ব্রিকসে । অর্থনীতি ও ভূরাজনীতির স্বার্থেই ব্রিক্স বাংলাদেশের জন্য লাভজনক হয়ে উঠতে বাধ্য।

২০২৪ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের। সে ক্ষেত্রে অনুন্নত ও স্বল্প আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যেসব সুযোগ সুবিধা পেত তার অনেক কিছুই থাকছে না। আর এই সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন জোটভুক্ত হওয়া, দ্বিপক্ষীয় চুক্তি এবং আঞ্চলিক চুক্তির দিকে মনোযোগ দিতে হবে বাংলাদেশকে।

এমন এক সময় ব্রিকস থেকে পাওয়া আমন্ত্রণ যেকোনো অবস্থাতেই লুফে নেবে বাংলাদেশ। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশের এই স্বার্থকে রাজনৈতিক মোড়কে আবৃত করে বিরোধিতা করা, দিন শেষে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বিরোধিতা করা। বাংলাদেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করা। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তৃতীয় কোনো শক্তির লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি করা।

ব্রিকস শুধু একটি জোট হিসেবে বাংলাদেশকে সহায়তা দিচ্ছে না, বরং এই জোটভুক্ত অন্যান্য দেশের সঙ্গে উন্নয়নমূলক এবং অর্থনৈতিক চুক্তি করার সম্ভাবনাকেও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই জোটভুক্ত যেসব রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের এখনো অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় হয়নি, সেই সম্পর্ক দৃঢ় করারও সুযোগ তৈরি হচ্ছে। এত সম্ভাবনাময় একটি উদ্যোগকে রাজনৈতিকভাবে ব্যাখ্যা করে দলীয় ক্ষুদ্র স্বার্থে দেশকে পিছিয়ে দেয়ার কোনো মানেই হয় না। তাই বিরোধিতা নয়, ব্রিকসকে স্বাগত জানানোই জরুরি।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট [সূত্র : দৈনিক বাংলা, ১৭ জুলাই ২০২৩।

  • মাসিক সংক্ষিপ্ত সম্পাদকীয়
  • International Affairs
  • ৪৩ তম বিসিএস ভাইবা প্রস্তুতি।
  • ৪৪ তম বিসিএস ভাইবা প্রস্তুতি।
  • ৪৫ তম বিসিএস রিটেন প্রস্তুতি।

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Ok, Go it!
close