The Palestinian-Israeli Crisis and Western supremacy - ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকট ও পশ্চিমা আধিপত্য
The Palestinian-Israeli Crisis and Western supremacy
- ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকট ও পশ্চিমা আধিপত্য ড. ফরিদুল আলম
বর্তমান বৈশ্বিক সংকটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকট সমাধানের পরিবর্তে নতুন নতুন সমস্যা নিয়ে হাজির হচ্ছে। কিছুদিন পর পর সব কিছু ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সংবাদের শিরোনাম হয়ে উঠছে এই সংকট।
একদিকে পশ্চিমাদের ভাষায় ইসরায়েলের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, অন্যদিকে ফিলিস্তিনের মানুষের নিজ বাসভূমে নিরাপদে বসবাসের স্বপ্ত- এই দুইয়ের মধ্যে বরাবরই আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী, যারা বর্তমান আন্তর্জাতিক রাজনীতির নিয়ন্ত্রক, তাদের পক্ষ থেকে ইসরায়েলের দাবির প্রতি সমর্থনের পাল্লাটিই বেশি ভারী হয়ে ওঠে।
এর জেরে ফিলিস্তিনের মানুষের কষ্ট, কান্না আর হাহাকারে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠলেও তাদের স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। নতুন করে তারা তাদের অধিকার নিয়ে যখন আবার সংগঠিত হয়ে ওঠে, ফের আক্রমণে বিপর্যস্ত হতে হয়, যা থেকে বাদ যায় না নারী-শিশু এবং বৃরাও। সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিম তীরের জেনিন শরণার্থীশিবিরে ঢুকে ইসরায়েল বাহিনী যেভাবে পৈশাচিক আক্রমণ চালিয়েছে, সেটা গত দুই দশকের মধ্যে ইসরায়েলের তরফ থেকে পরিচালিত যেকোনো হামলাকে ছাড়িয়ে যায়।
প্রথমে আকাশ থেকে ড্রোন আক্রমণ, পরে সাঁজোয়া যান এবং বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় শরণার্থীদের আশ্রয়স্থল । হাজার হাজার মানুষ জীবন বাঁচাতে ছোটাছুটি করতে থাকে যত্রতত্র। তার পরও রেহাই পায়নি তারা। ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে তিনজন শিশু।
এই নিরপরাধ শিশুরা জানে না কী তাদের অপরাধ! এবারের হামলায় বেসামরিক মানুষের বাসস্থান, এমনকি হাসপাতাল পর্যন্ত রক্ষা পায়নি। কয়েক হাজার মানুষ আহত হয়েছে। কিছু মানুষের আঘাত গুরুতর। এর আগে ২০০২ সালের এপ্রিল মাসে ইসরায়েলি বাহিনী এই এলাকায় পূর্ণমাত্রায় সামরিক অভিযান পরিচালনা করে, যাতে ৫২ জন ফিলিস্তিনি ও ২৩ জন ইসরায়েলি সেনা নিহত হয়েছিলেন।
এই হামলার পর যথারীতি আন্তর্জাতিক সমাজের যে প্রতিক্রিয়া, তা আমাদের হতাশ করলেও অবাক করেনি। তারা ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের পক্ষে সোচ্চার হয়েছে। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তারা সেখানে সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিয়েছে, ফিলিস্তিন যোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত জেনিন ব্রিগেডের গোপন অস্ত্রভাণ্ডার ধ্বংস করেছে এবং এর মধ্য দিয়ে আপাতত সেখানে তাদের অভিযান শেষ হলেও এটা এককালীন কোনো সমাধান না বলেও সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে জেনিন শরণার্থী শিবিরে হামলা শেষ করে তারা নতুন করে বিমান হামলা চালিয়েছে ফিলিস্তিনের গাজা শহরে। এখন পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে সার্বিকভাবে জানা না গেলেও ধারণা করা যায় যে, যদি এই হামলাও আগামী কয়েক দিন অব্যাহত থাকে, তাহলে গাজায় বসবাসরত ফিলিস্তিনের অধিবাসীরাও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়বে।
এর আগে গত মে মাসে গাজায় কয়েক দিন ধরে যুদ্ধবিমান নিয়ে হামলা করে ইসরায়েলি বাহিনী। সে সময় তাদের পক্ষ থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর প্রতি ছোড়া রকেট হামলার জবাবে এই হামলা পরিচালনার কথা বলা হয়। কয়েক দিন ধরে চলা এই হামলায় ৩১ জন ফিলিস্তিনি প্রাণ হারায়।
কেন এই হামলা? এই হামলার যুক্তি হিসেবে ইসরায়েল দাবি করেছে, তাদের নিরাপত্তা বাহিনীকে উদ্দেশ্য করে হামলা চালানো হয়েছে। এই হামলা এবং গোপন অস্ত্রের উৎস হচ্ছে জেনিন শরণার্থী শিবির। এর আগেও আমরা দেখেছি এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের নামে তারা গত বছর জেনিন শিবিরে সংবাদ সংগ্রহ করতে যাওয়া আলজাজিরার এক নারী সাংবাদিককে গুলি করে হত্যা করেছে।
এর জন্যও কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে সে রকমভাবে তাদের কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়নি। ফিলিস্তিনের মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিনের যে ক্ষোভ, সেটা গত প্রায় ছয় দশক ধরে পুঞ্জীভূত কষ্ট ভেদ করে তাদের দিক থেকেও এক ধরনের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারে পরিণত হয়েছে। আমরা জানি, ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে পশ্চিম তীরের দখল নেয় ইসরায়েল। ফলে শরণার্থীতে পরিণত হয় ফিলিস্তিনের লাখো মানুষ।
জীবন ও জীবিকার তাগিদে ব্যাপক মানুষ বাস্তুচ্যুত ও শরণার্থীতে পরিণত হয়ে প্রতিবেশী আরব দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বসবাস করছে। নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদকৃত ফিলিস্তিনিদের বদলে সেখানে আশ্রয় গেড়েছে ইসরায়েলের প্রায় পাঁচ লাখ নাগরিক। তারা তাদের ভূমি ফেরত চায়, নিজ ভূমি রক্ষার্থে আন্দোলনপ্রতিবাদ হয়ে আসছে দীর্ঘ সময় ধরে।
আজ যদি তাদের সশস্ত্র যোদ্ধা বলা হয়, সে ক্ষেত্রে নিজেদের প্রশ্ন করলে উত্তর পাব যে আজকের প্রজন্ম আগের প্রজন্মের চেয়ে অনেক বেশি অধিকার সচেতন হয়ে উঠছে। ইসরায়েলের ভাষায় যারা অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী, ফিলিস্তিনের ভাষায় তারা কিন্তু মাতৃভূমির অধিকার রক্ষায় অকুতোভয় সংগ্রামী যোদ্ধা।
এই হামলার পেছনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হতে পারে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নতুন জোট সরকার। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ষষ্ঠবারের মতো ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করাটা খুব একটা সহজ ছিল না নেতানিয়াহুর জন্য।
সরকার গঠনের জন্য ইসরায়েলের পার্লামেন্ট নেসেটে প্রয়োজনীয় সমর্থন না থাকায় তাঁকে জোট করতে হয়েছে কয়েকটি অতি ডানপন্থি দলের সঙ্গে, যার মধ্যে একটি হচ্ছে রিলিজিয়াস জিওনিজম পার্টি, যার প্রধান ইতামার বেন গভিরকে ছেড়ে দিতে হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
মূলত নেতানিয়াহু এর আগে প্রায় ১৫ বছরের শাসনকালে তাঁকে হটাতে আরব এবং ইসলামপন্থি দলগুলোকে নিয়ে করা জোট সরকারের বিপক্ষে সাধারণ ভোটারের মনোভাব বুঝে এবং নিজ ক্ষমতাকে পোক্ত করতে তাঁর এই অবস্থান, যার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের আগ্রাসন অব্যাহত রাখা।
ইসরায়েলের বর্তমান ক্ষমতাসীন লিকুদ পার্টির ক্ষমতায় থাকার ক্ষেত্রে এটিকেই মূলমন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর সেজন্যই মাঝের যে সময়টাতে নেতানিয়াহু ক্ষমতায় ছিলেন না, সে সময় ইসরায়েলের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে আক্ৰমাণাত্মক কোনো উদ্যোগ নেওয়া না হলেও ক্ষমতাসীন হওয়ার পরপরই দফায় দফায় সংঘাতে জড়িয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন, যার কারণ অনুমেয়।
দীর্ঘ সময় ধরে চলা এ সমস্যার সবচেয়ে বড় যে সংকট এখন পর্যন্ত জিইয়ে রাখা হয়েছে, তা হলো ফিলিস্তিনের শরণার্থী সমস্যা। ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করা জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস রিলিফস অ্যান্ড ওয়ার্কস এজেন্সিতে (ইউএনআরডাব্লিউএ) নিবন্ধিত ফিলিস্তিনি শরণার্থীর সংখ্যা ৫৩ লাখ।
এর মধ্যে জর্দানে রয়েছে ২০ লাখ, সিরিয়ায় রয়েছে ৫ লাখ ২৬ হাজার, লেবাননে ৫ লাখ এবং প্রতিবেশী আর কিছু দেশে তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের দুর্দশা আরো বেড়েছে। ২০১৮ সালে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য সব ধরনের মানবিক সাহায্য-সহযোগিতা পুরোপুরি বন্ধ ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র।
ইউএনআরডাব্লিউএকে তহবিল দেওয়া বন্ধ করে দেয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন। তখন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, ফিলিস্তিনিরা যতক্ষণ পর্যন্ত না ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে সম্মত হবে, তাঁর দেশ ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো সহযোগিতা দেবে না ফিলিস্তিনকে। এরপর ফিলিস্তিনি শরণার্থীরা আরো দুর্ভোগের মধ্যে পড়ে।
ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের অপেক্ষাকৃত ভালো জীবনের সন্ধানে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার পেছনে এটা একটা কারণ হতে পারে। সংগত কারণেই প্রশ্ন থেকে যায়, কীভাবে এই সমস্যার সমাধান হবে? অনেকের ধারণা, দুই পক্ষের মধ্যে শান্তি আলোচনাই সমস্যা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায়।
আমরা যদি নিকট অতীতের এ ধরনের শান্তি আলোচনার উদাহরণ টানি, তাহলে দেখতে পাব কিছু ক্ষেত্রে উভয় পক্ষ একমত হয়ে সংঘাত থেকে বেরিয়ে এলেও এটা খুব বেশিদিন কার্যকর থাকেনি। এখানে আমাদের গভীরভাবে চিন্তা করে দেখতে হবে, অধিকৃত ভূখণ্ডে ইসরায়েলের বসতি স্থাপন অব্যাহত রেখে কোনো ধরনের শান্তি আলোচনা সফল হতে পারে না।
ইসরায়েল শুধু ফিলিস্তিনের নাগরিকদের ওপর আর কখনো আক্রমণ করবে না, এই নিশ্চয়তা ফিলিস্তিনের জনগণের দাবি পূরণে যথেষ্ট নয়। তাহলে যা দাঁড়াল তা হচ্ছে ইসরায়েলকে নিঃশর্তভাবে অধিকৃত ভূখণ্ড ত্যাগ করে, তা ফিলিস্তিনের জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। সেটা বর্তমান বাস্তবতায় তারা কখনো চাইবে না, আর তাদের এই না চাওয়ার পেছনে পূর্ণ সমর্থন রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা পশ্চিমা দুনিয়ার।
এই বাস্তবতায় সাম্প্রতিক সময়ে চীনের পক্ষ থেকে দুই পক্ষকে নিয়ে এক শান্তি আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে তেমন কোনো ইতিবাচক সাড়া দেওয়া হয়নি। তবে গোটা বিষয়টি নির্ভর করবে চীন নিজেকে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে কতটা অপরিহার্য করে তুলতে পারবে তার ওপর।
সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরবের সঙ্গে তারা নতুন করে কৌশলগত সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছে, যার ফলে সৌদি রাজনীতিতে মার্কিন আধিপত্য অনেকটা খর্ব হয়েছে। ধারণা করা যায়, আগামী বছরগুলোতে দুই দেশের মধ্যে ব্যাপক বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হতে যাচ্ছে, যার জেরে কাতার, আরব আমিরাতসহ আরো কিছু দেশের চীনমুখী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তারা সম্প্রতি ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ককে স্বাভাবিক করতে উদ্যোগ নিয়েছে। এটা ফলপ্রসূ হওয়ার ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। সবকিছুর বিচারে মধ্যপ্রাচ্যের ভৌগোলিক রাজনীতিতে পশ্চিমা আধিপত্য হ্রাসই শুধু ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকট সমাধানে নতুন আশাবাদ সৃষ্টি করতে পারে।
লেখক: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় [সূত্র : কালের কণ্ঠ, ৮ জুলাই ২০২৩]
International Affairs
- ৪৩ তম বিসিএস ভাইবা প্রস্তুতি।
- ৪৪ তম বিসিএস ভাইবা প্রস্তুতি।
- ৪৫ তম বিসিএস রিটেন প্রস্তুতি।
crisis and western supremacy, crisis and western supremacy, crisis and western supremacy, crisis and western supremacy, crisis and western supremacy, crisis and western supremacy