জ্যা পিয়েরে ল্যাক্রোইক্সের আসন্ন বাংলাদেশ সফর শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের শক্তিশালী অবস্থান - J. Pierre Lacroix's upcoming visit to Bangladesh is Bangladesh's strong position in the peacekeeping mission
জ্যা পিয়েরে ল্যাক্রোইক্সের আসন্ন বাংলাদেশ সফর শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের শক্তিশালী অবস্থান লেখক: ড. দেলোয়ার হোসেন
জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জ্যা পিয়েরে ল্যাক্রোইক্স, যিনি ডিপার্টমেন্ট অব পিস অপারেশনের দায়িত্বে আছেন। এ মাসের ২৫-২৬ তারিখে বাংলাদেশ সফর করবেন। এই সফরের উদ্দেশ্য হচ্ছে জাতিসংঘের একটি শান্তিরক্ষী মিনিস্টারিয়াল বৈঠকের প্রস্তুতি। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশ এই আসরের সহ-আয়োজক। কানাডা এবং উরুগুয়ের পাশাপাশি এটি বাংলাদেশ একসঙ্গে আয়োজন করছে। শান্তিরক্ষী মিশনে জাতিসংঘ গত কয়েক দশকে যে গতিশীল ধারা তৈরি করেছে সেখানে বাংলাদেশ একটি নেতৃস্থানীয় অবস্থানে রয়েছে। তার স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘের এই শীর্ষ কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফর করছেন।
জাতিসংঘের এই শীর্ষ কর্মকর্তার সফর আবারও প্রমাণ করে যে, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অবস্থান কতটা শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ শান্তিরক্ষা মিশনে সৈন্য প্রেরণের দিক থেকে প্রথম স্থান অধিকার করে আছে ৭,৫০০ শান্তিরক্ষী প্রেরণের মাধ্যমে। বাংলাদেশ পুলিশ থেকেও সদস্যরা যাচ্ছেন। বাংলাদেশ থেকে জাতিসংঘ আরও বেশি সংখ্যক শান্তিরক্ষী চাচ্ছে। শান্তিরক্ষী প্রেরণে বাংলাদেশের যে ঐতিহ্য তারই ধারাবাহিকতায় এই সফর। বাংলাদেশ থেকে প্রেরিত এই সংখ্যা প্রতিবছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। শান্তিরক্ষা মিশনের যে সিদ্ধান্ত প্রণয়নের পদগুলো রয়েছে সেখানেও বাংলাদেশের অবস্থান বেশ শক্তিশালী। বিগত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী পদে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ। ফলে এই সফর বাংলাদেশের জন্য এক বড় ধরনের সম্ভাবনা তৈরি করছে।
তবে এই সফরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের ভেতরের কিছু গোষ্ঠী এবং আন্তর্জাতিক মহলেরও কিছু অংশ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জাতিসংঘকে ব্যবহার করার তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষ করে জাতিসংঘের কর্মকর্তা জ্যা পিয়েরে ল্যাক্রোইক্সের কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক তথ্য দেওয়ারও প্রচেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে। এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। যদিও বাংলাদেশের ভূমিকার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রভাব ফেলার সুযোগ নেই এসব তথ্যের। কেননা জাতিসংঘের যেকোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় অত্যন্ত সূক্ষ্ম নিরীক্ষার মাধ্যমেই।
এক সুদীর্ঘ ঐতিহ্য ও ব্যাপক কর্মযজ্ঞের ধারাবাহিকতারই বহিঃপ্রকাশ বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের আজকের অবস্থান। অতীতের বিভিন্ন মিশনে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের দ্বারা যে ধরনের সুনাম ও কৃতিত্ব অর্জন হয়েছে, মানবাধিকারসহ অন্যান্য স্পর্শকাতর বিষয়ে তাদের যে যত্নশীল অবস্থান, তা উদাহরণ হিসেবে বেশ বিরল। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সম্পর্কই এর প্রমাণ।
প্রতিটি মিশনের প্রতিটি সদস্যের ওপর জাতিসংঘের নজর আছে। কেননা প্রত্যেকটি মিশনের একটি নেতৃত্ব আছে, মাঠ পর্যায়ের নেতৃত্ব যেটি ফোর্স কমান্ডার্স হেড কোয়ার্টার্স বা, বিভিন্ন ডিসিপ্লিনারি ফোর্স তারা যেমন নজরদারি বজায় রাখে, তেমনি বেসামরিক নেতৃত্বও এই নজরদারিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অসদাচরণের অভিযোগ এবং পরবর্তী পদক্ষেপগুলোর রেকর্ড রক্ষণাবেক্ষণ এবং ডাটা ট্র্যাকিং ২০০৬ সালে শুরু হয়েছিল। ২০০৮ সালের জুলাই মাসে ফিল্ড সাপোর্ট বিভাগ শান্তিরক্ষী কর্মীদের সঙ্গে জড়িত অসদাচরণের সব অভিযোগের জন্য একটি বৈশ্বিক ডাটাবেজ এবং গোপনীয় ট্র্যাকিং সিস্টেম, অসদাচরণ ট্র্যাকিং সিস্টেম (এমটিএস) চালু করে। এ রকম এক কার্যকর নজরদারির ভেতরেও বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা দক্ষতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছেন বছরের পর বছর।
বাংলাদেশের একটি সুনামের জায়গা, গর্বের জায়গায় আক্রমণ করা হয়েছে বারবার। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরেরই কিছু শক্তি একে উসকে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এমনকি কিছু প্রতিষ্ঠান সবসময়ের মতোই এই বিষয়গুলো নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাচ্ছে। তবে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের এসব বিষয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই । মানবাধিকার নিয়ে তাদের বক্তব্য পৃথিবীজুড়েই আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হোক, চীন হোক, ফ্রান্স বা ভারত হোক, তাদের প্রতিবেদনে মানবাধিকারের বিষয়টির উল্লেখ থাকবেই। ফলে তাদের এই ধরনের তৎপরতা খুবই স্বাভাবিক। গত মে মাসে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে আত্মোৎসর্গের জন্য পাঁচ বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীকে ‘ড্যাগ হ্যামারস্কজল্ড মেডেল' প্রদান করেছে জাতিসংঘ।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালনকালে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের ১৬৬ শান্তিরক্ষী প্রাণ হারিয়েছেন। বিস্ময়কর হচ্ছে, বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের অর্জন ও বিসর্জন, যে পরিমাণ ত্যাগ তারা স্বীকার করেছেন সেটিকে ম্লান করার জন্য, এর ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য জাতিসংঘের ভেতরে এক ধরনের বাংলাদেশবিরোধী মনোভাব তৈরি করা সেটি সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য। প্রশ্ন থেকেই যায়, কেন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের এ ধরনের বিষয়ের সম্মুখীন হতে হবে। ১৯৮৮ সাল থেকে বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী মিশনের অংশ। তবে কেন আরও আগেই বাংলাদেশ এই ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হলো না? তবে কি বাংলাদেশ রা, বা এর কূটনীতি বা এর পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কারও আপত্তি আছে? আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের যে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি হয়েছে, সেটি নিয়ে কারও দুশ্চিন্তা আছে? বোঝাই যাচ্ছে এটি তৈরি হয়েছে এক বিশেষ উদ্দেশ্যে, যেখানে বাংলাদেশকে বিতর্কিত করার অপপ্রয়াসই মুখ্য উদ্দেশ্য। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মানবাধিকারের মতো স্পর্শকাতর বিষয়কে করা হচ্ছে বিতর্কিত।
এসবের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, বাংলাদেশ রয়েছে সঠিক পথে। যে বিষয়গুলো নিয়ে এতকাল কোনো ধরনের বক্তব্য আসেনি, জাতীয় নির্বাচনের ছয় মাস আগে এ ধরনের বিষয় নিয়ে কথা বলা কীসের ইঙ্গিত, কিসের বার্তা দেওয়া হচ্ছে? বিষয়গুলো খুবই স্থুল ও অত্যন্ত দুঃখজনক। ফলে জাতিসংঘের সঙ্গে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা নিয়ে যে শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে সেটি আরও বিস্তৃত হবে। জাতিসংঘ একটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংগঠন, যেখানে বাংলাদেশ একাধিকবার নিরাপত্তা পরিষদে নেতৃত্ব দিয়েছে, বাংলাদেশ বর্তমানে হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য। কিছুদিন আগে বাংলাদেশের প্রস্তাবিত কালচার অব পিস বা শান্তির সংস্কৃতির প্রস্তাব ১০০টি রাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথভাবে পাস হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের অবস্থান জাতিসংঘের কাছে স্পষ্ট। এটি নিয়ে জাতিসংঘে বিভ্রান্তি তৈরির কোনো অবকাশ নেই। জাতিসংঘ অবশ্যই সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। বাংলাদেশকে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে আরও বেশি সংযুক্ত করবে জাতিসংঘ এই সম্ভাবনা যে বেড়ে যাবে, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
- আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষক ও অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) [সূত্র : সময়ের আলো, ২০ জুন ২০২৩)
- ড. দেলোয়ার হোসেন
- মাসিক সংক্ষিপ্ত সম্পাদকীয়
৪৩ তম বিসিএস ভাইবা প্রস্তুতি।
৪৪ তম বিসিএস ভাইবা প্রস্তুতি।
৪৫ তম বিসিএস রিটেন প্রস্তুতি।