নীল তৃষ্ণা (এক টুকরো রোদ) - ১০

Mofizur Rahman
0

নীল তৃষ্ণা (এক টুকরো রোদ) - ১০

নীল তৃষ্ণা (এক টুকরো রোদ) - ১০

নীল তৃষ্ণা

আকাশের চাঁদ আর তারার খেলায় শফিক বিভোর হয়ে থাকে। অনেক দিন পর চাঁদের উছলে পড়া জ্যোৎস্নায় সে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। পুকুরের সান বান্ধা এই ঘাটটিতে তার অনেক সময় কেটেছে। প্রায় রাতে এখানে এসে না বসলে তার ঘুম আসতো না চোখে। খাটের কোণায় ইজি চেয়ারের মত জায়গাটায় হেলান দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আকাশের দিকে চেয়ে থাকতো । কি এক অজানা চোখের নেশা যেন ঐ তারা আর নক্ষত্রের মেলায় লেগে থাকতো।

চোখ ফেরাতে পারতো না একটি তারা হঠাৎ কক্ষচ্যুত হওয়ার ব্যাপারটাকে ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছে শয়তানকে তীর ছুড়ে মারার এক অলৌকিক কাহিনী কিশোর বয়সেও এই দৃশ্য চোখে ভেসেছে তখনই তীর ছোড়ার কথা মনে পড়েছে সৌর জগতের বিচিত্র তথ্য জানার পরও তা মন থেকে মুছে যায়নি। তেমনিভাবে মনের কোন ফাঁকে শিউলি যে লেগে আছে তা ঠিক বুঝতে পারে না । একাকী নিঃসঙ্গতার ভেতর এখনো তার চেহারাটি ভেসে উঠে। চোখ দু'টি শান্ত দিঘীর জলের মত স্থির হয়ে আপন ভাষায় কথা বলে। সবুজ পত্রের মত সতেজ মুখখানি কখনো ম্লান হতো না।

দুঃখ কষ্টের কোন আঁচড় যেন তাকে ছুঁতে পারতো না। মার শত বকুনি খেয়েও যে ছুটে আসতো পুকুর পাড়ে। কখনো পড়ার নাম করে কখনো বা গরমের দোহাই দিয়ে ছুটে আসতো এই ঘাটলায় শীতের সকালে মিষ্টি মিষ্টি রোদ যখন লতা পাতাকে ছুঁতে শুরু করতো তখন সে এখানে এসে বই মেলে পড়তে বসতো। সেসময় পুকুরের বরফ শীতল পানির উপরে ধোঁয়ার মেঘ যেন ধীরে ধীরে বিলীন হতে শুরু করতো। শিউলি পড়া থামিয়ে জানতে চাইতো, শীতের সকালে পানিতে ধোঁয়া হয় কেন? শফিক উত্তর দিতে না পেরে বলতো, পড়ার সময় কথা বলা ঠিক না।

অথচ কিছুক্ষণ পর সে নিজে আবার পুকুরের দক্ষিন-পূর্ব কোণার দিকে তাকিয়ে বলতো, দেখ সাদা বকটি কুয়াশা আর পানির ধোঁয়ার ভেতর মাছ ধরার জন্য গলাগুটিয়ে জড়োসড়ো হয়ে কেমন করে দাঁড়িয়ে আছে শিউলি আবার জানতে চাইতো, পাখিদের শীত লাগে না? শফিক বলতো, সাদা পালকের ছাদর মুড়ে আছে সারা শরীর, শীত লাগবে কিভাবে? তখন সে আক্ষেপ করে বলতো, আহা যদি পাখিদের মত হতে পারতাম। তার সেই আক্ষেপ এখনও যায়নি। অনেক বছর পর আজ বিকেলে দেখা হয়েছে তার সাথে।

ছেলে মেয়েদের বার্ষিক পরীক্ষা শেষে সে বাপের বাড়ি এসেছে বেড়াতে। বৎসরে অন্ততঃ একবার এসে সে ছোটবেলার স্মৃতিময় জায়গাগুলি দেখে যায়। কেমন এক অদ্ভুত মায়া যেন জড়িয়ে আছে এসবের সাথে। বহুদিন পর্যন্ত শফিকের সাথে দেখা হয় না, আজ হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়ায় সে কেমন যেন নার্ভাস হয়ে পড়ে। ঠিক গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। কিছুক্ষণ পর শফিক জানতে চাইলো, কেমন আছিস সে অভিযোগ আর আক্ষেপ মিশিয়ে বললো, ভালো; তবে আমাদের খবর কে রাখে।

শফিক ওর কথাটা ফিরিয়ে দিয়ে বলে, ইচ্ছা করলে তুই পারতি না? তখন শিউলি তার পুরনো কণ্ঠে বলে, আমারতো আর পাখির মত পাখা নেই, উড়ে গিয়ে খবর নিয়ে আসি শফিক মন্তব্য করে তুই আগের মত রয়ে গেছিস। কথাটা শুনে সে হেসে উঠে। তখন তার ছোট বাচ্চাটি ঘুম থেকে জেগে কাঁদতে শুরু করে। সে দৌড়ে ঘরের ভেতর চলে যায়।

শফিক আবার তারাদের মাঝে ডুবে যায়। খুব ছোট বেলায় মা উঠানে বসে চাঁদ আর তারার গল্প শুনাতো। তার কোনটাই মনে নেই এখন। আহা সেসব গল্প যদি এখন মনে করতে পারতো কি আনন্দ না হতো শিশুকালের স্মৃতিকথারা মানুষের মনে থাকে না কেন এই মুহুর্তে বুঝতে পারে না শফিক। তখন হঠাৎ শিউলির কন্ঠ শুনে সে চমকে উঠে । তুমি একা একা কি করছো এখানে?

সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, আকাশের তারা দেখছি।
এখনও আকাশ দেখা ছাড়তে পারনি।
সুযোগ হয় না দেখার।

কেন আকাশ কি ওখানে নেই? নগর জীবন এতবেশি ছকে বেঁধে ফেলেছে এদিক ওদিক হওয়ার কোন সময় পাই না।
সবাইতো ঐরকম জীবন চায়।
ব্যস্ততার মাঝে একধরনের আনন্দ আছে কিন্তু যান্ত্রিকতার কারণে তা ম্লান হয়ে যায়।

নগর জীবনের আকর্ষণ কেউ এড়াতে পারে না। আকর্ষণ নয়, বলতে পার মোহ, প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্যের সাথে তার তুলনা হয় না সবাইতো আর তোমার মত প্রকৃতি প্রেমিক না । জ্যোৎস্নার এমন এক অপূর্ব রাত ওখানে কল্পনাও করা যায় না। নিয়ন বাতির আলোতে সারা শহর আলোকিত থাকে, ওখানে চাঁদের আলোর কি প্রয়োজন।

চাঁদের আলো কখনো দৃষ্টি ফিরিয়ে দেয় না, তার কোমল রূপালী আলোর বন্যায় প্রকৃতির সবকিছু ডুবে যায় । আর নিয়নের আলোতে কি হারিয়ে যায় নাকি ?
হ্যাঁ জ্যোৎস্নায় ডুবে যাওয়া দৃশ্য চোখের ওপর মূর্ত হয়ে ভাসে।

সেজন্যতো এত ভালো লাগে। কাঁঠাল গাছটির দিকে চেয়ে দেখ। জ্যোৎস্না কেমন মায়াময় করে তুলেছে গাছটিকে। পাতার ফাঁকে ফাঁকে ডাল-পালায় জ্যোৎস্না কি অপুর্ব খেলায় মেতে উঠেছে। পাতার ওপর জ্যোৎস্নার আলো আর নীচে কেমন মায়ারী তরল আঁধার। গাছের নীচে ঘাসের উপর পাতা গলিয়ে টুকরো টুকরো চাঁদের আলো যেন নেমে এসেছে আকাশ থেকে।

শিউলি শফিকের কাছে এসে নিঃশব্দে বসে পড়ে। পুকুর পাড়ের গাছগুলো এখনও আছে তবে আগের মত পত্র-পল্লবের ভারে নুয়ে পড়ে না আর । নতুন গাছও কয়েকটি বেড়ে উঠেছে কিন্তু পুরানো গাছের মত ডাল-পালা ছড়িয়ে বৃক্ষের রূপ নিতে পারেনি এখনো। তবুও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পুরানোদের ফাঁকে ফাঁকে। পাতারা এখনো যেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে গাছের শাখায় শাখায় দোল খেয়ে চলছে। বাতাসের ছোট ছোট ঢেউ ওলট-পালট করে দিতে চায়।

বেগ একটু বাড়লে ডালপালা নড়ে উঠে, আর একটু বাড়লে পুরো গাছটি দোল খেতে খেতে একসময় স্থির হয়ে যায়। পুকুরের শান্ত জলে গাছের প্রতিচ্ছবি তখন ছন্দের তালে তালে নিঃশব্দে কাঁপতে থাকে। পুরানো গাছের পাতাকে আড়াল করে চাঁদের আলো নীচের ছায়াচ্ছন্ন জায়গাটিতে পৌঁছতে পারে না। পাতার ওপর পাতা ডাল পালার সাথে ছনের ছাউনির মত জড়িয়ে থাকে যেন রোদ বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করে। দিঘীর স্বচ্ছ জলের ভেতর গাছগুলি যেন মাথা নীচের দিকে দিয়ে উপুড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পূর্বকোণের কুল গাছটি কাত হয়ে ঝুঁকে আছে পানির উপর।

কয়েকটি ডালপাতা পানি ছুই ছুই করছে। শিউলি নিরবতা ভঙ্গ করে বলে, পেছনের পুকুর পাড়ের বরই গাছটির কথা তোমার মনে আছে।

তুফানে পড়ে গিয়েছিল যে গাছটি। হ্যাঁ ওটার চারা এই গাছটি, বরই একেবারে ওটার মত মাঝের কাঁঠাল গাছে আগের মত কাঁঠাল ধরে ? না, ওরকম বড় হয় না আর বাতি হওয়ার আগে ফেটে যায়।
কেন?
চোরের হাত লেগেছে নাকি ।
এসব তুই বিশ্বাস করিস?
করিনা, তবে মাঝে মধ্যে মনে হয় এসব কথা একেবারে অযথা বলেনা, নিশ্চয় কোন না কোন কারণ আছে।

আমি কোন কারণ খুঁজে পাই না, আমার মনে হয় স্রেফ কুসংষ্কার আগেতো বেশ কাঁঠাল ধরতো, কখনো ফাটতো না, এখন এরকম হয় কেন? শোন তাহলে, মানুষের যখন বয়স বাড়তে বাড়তে একেবারে শেষের দিকে এসে পৌঁছে তখন কি তাদের আর সন্তান সন্ততি আসে? বৃক্ষও সেরকম। ফলবান বৃক্ষও একদিন ফুল ফল এমনকি পাতাহীন হয়ে পড়ে। মানুষ আর বৃক্ষ কি এক?

এক না; সব কিছুরই একটা সময় আছে। যেমন পাশের কচি গাছগুলোতে এখনও কোন ফল ধরে না, একদিন ধরবে, পুরানো আম গাছটিতে আগের মত আম ধরে না, একদিন হয়ত আর ধরবেও না।
এভাবে স্কুলের পড়াগুলো তুমি আমাকে বুঝিয়ে দিতে, আমি মনে রাখতে পারতাম না তাই পড়া-লেখা তেমন করতে পারিনি। এস. এস. সি তে তুই ভালো পাশ করেছিলি । সেটা কি একটা লেখাপড়া হলো ভালো পাশ কর লাভ কি হলো? আর তো কলেজে ভর্তি হতে দিলো না। বিয়ের জন্য সবাই উঠে পড়ে লাগলো আমি না করলাম। কত রকমের কথা শুনতে হলো।

তখন মুখ খুলে বলতে পারতি?
আমাদের কি মুখ খোলার কোন সুযোগ আছে। তোমাকে যদি বলেই বুঝাতে হয়; তাহলে অন্যদেরকে কি করে বুঝাবো।
পড়া ছেড়ে না দিলে হতো না? কোথায় পড়ব এই কলেজতো তখনও শুরু হয়নি আর তুমিতো বাক্স-পেটি বন্ধ করে শহরে চলে গেলে কলেজে ভর্তি হতে। আমার কথা কি একবারও ভেবে দেখেছিলে?

তখন মেয়েদের লেখাপড়াকে কেউ এভাবে নেয়নি। তুই যে এস.এস.সি পরীক্ষা দিলি তার জন্য কত কথা চারিদিকে বলাবলি হয়েছে মনে আছে?
যে যাই বলুক লেখাপড়া করতে পারলে আজ জীবনটা অন্যরকম হতো।

এখন কি তোরা খারাপ আছিস? তুই একজন আদর্শ গৃহিনী। তোর স্বামী একজন স্কুল শিক্ষক। কি সুন্দর তোদের জীবন। নিশ্চয় সুখে আছিস? তা খুব সুখে আছি কিন্তু কোথায় যেন তাল খুঁজে পাই না। কি এক শুন্যতা নিজের ভেতর হাহাকার করে উঠে।

না, সেতো আমাকে ভীষণ ভালবাসে, আর তার মত ভালো লোক খুব কম আছে। তাহলে?
বুঝিনা, কোথায় যেন একধরনের তৃষ্ণা অনুভব হয়, যা কাউকে বলাও যায় না, ভাবতেও কষ্ট হয়।
কি রকম তৃষ্ণা?

শরতের সকাল ধানের শীষে বিন্দু বিন্দু জমে থাকা শিশির কণায় যখন সুর্যের আলো এসে পড়ে তখন ধান গাছের পাতা ধীরে ধীরে মেলে যায়। সে দৃশ্য কখনো দেখেছো তুমি ।

দেখেছি । শিশির বিন্দুরা তারার মত জ্বলে তখন। কিন্তু জড়িয়ে থাকা পাতারা যে মেলে যায় তা দেখনি।
শফিক মাথা নেড়ে জওয়াব দেয়, না ।
অনেকে দেখতে পায় না, আমি কিন্তু দেখি। তখন তৃষ্ণার চোখ খুলে যেতে থাকে।

অতীতের ছোট ছোট বিন্দু ঘটনা প্রবাহ একের পর এক চোখের উপর ভাসতে থাকে। তোর অতীতে এমন কি ঘটনা আছে যা তোকে এভাবে ভাবিয়ে তোলে? বলার মত কোন ঘটনা খুঁজে পাই না। তারপরও ছোট ছোট ঢেউয়ের মত অতি আপন অজানা কিছু কিছু দুঃখ ব্যথা আনন্দ-বেদনার সাথে মিলে মিশে যেন একাকার হয়ে যায়।

দুঃখ ব্যথা! কিসের দুঃখ ব্যথা?
সেসবের মাঝে ডুবে যেতে যেতে একসময় নিজেকে হারিয়ে ফেলি। শিশির বিন্দুরা রোদ আর বাতাসের সান্নিধ্যে যতক্ষণ না মিলিয়ে যায় ততক্ষণ আমি বিভোর হতে থাকি ঐ তৃষ্ণার ভেতর।
এসব কি বলছিস তুই আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আমারটা কেউ বুঝতে পারে না, কি সংসার, কি স্বামী, কেউ না ।
খুলে বলবি তো?
এসবতো খুলে বলার ব্যাপার না।

তোদের বুঝা খুব কঠিন, কি ভেতরে কি বাইরে।
বুঝতে চাইলে খুব সহজ। আর সহজ কথাটি তোমরা সহজভাবে নিতে পার না।
বলে এত কঠিন মনে হয়।
কি বলতে চাস সরাসরি বল। এতদিন পর তা আর হয় না এতদিন পর মানে।

থাক সে কথা, যে কথা আগে বলতে পারিনি তা আর নতুন করে বলে তোমার মনকে ভারী করতে চাই না। এখানে মন ভারী হওয়ার এমন কি ব্যাপার আছে, আমি বুঝতে পারছি না। তোমার আর বুঝতে হবে না, বল ভাবী বাচ্চারা কেমন আছে?
ভালো। তোর ভাবীকে তো খুব ব্যস্ত থাকতে হয়। চাকরী আর সংসার সহজ কথা নাকি সকালে ঘুম থেকে উঠে শুরু হয় সংসারের কাজকর্ম। ছেলে-মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আসা তারপর নিজের স্কুল। আবার ওদেরকে স্কুল থেকে নিয়ে আসতে হয়। কাজের মেয়ে আছে না বাসায়?

বেচারীর এক মুহুর্ত ঠাঁই নেই ।
তা আছে। পুরোপুরি ওদের নির্ভর করা যায় না।
মেয়েটা বড় না?
হ্যাঁ।
সে এখনো একা যেতে পারে না?
একা যাবে কি করে? সিক্সে উঠেছে এবার আর শহরের পরিবেশ এখন মোটেই ভালো নয়।

ছেলে মেয়েদের নিয়ে সবাই শংকিত। পরিবেশ এখন গ্রামেও খারাপ হয়ে গেছে। আগে অন্ততঃ এখানে মানুষ মান সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে পারতো। এখন কেউ কাউকে মানে না। আর স্কুলতো একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে, লেখাপড়ার মান কোথায় পৌঁছেছে চিন্তাই করতে পারবে না। সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ আর ছিনতাইকারীরা অন্ততঃ দখল করতে পারেনি।

কোথায় আছ তুমি। সপ্তাহ খানেক থাক, তারপর বুঝতে পারবে কি হাল হয়েছে। গত শুক্রবার পুকপাড়ার রফিজার বাপের বড়ছেলে আজিজ এসেছে দুবাই থেকে পাঁচ বৎসর পর। সে রাতেই বাড়ীর সবাইকে বেঁধে রেখে গহনা গাটি দামী জিনিসপত্র সব নিয়ে গেছে কারা করেছে এসব ?
পাড়ার সন্ত্রাসী ছেলেরা।

ওরা কাদের ছেলে চিনতে পেরেছে নাকি? চিনতে ঠিকই পেরেছে কিন্তু এখন ভয়ে মুখ খুলছে না, যাওয়ার সময় নাকি শাসিয়ে গেছে, কাউকে নাম বললে খুন করে ফেলবে। খুন শব্দটা শুনে শফিক কিছুটা বিমর্ষ হয়ে পড়ে। তারপর আকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে । শহরের মত গ্রামেও এই শব্দটা এত সহজ হয়ে গেল কেন বুঝে উঠতে পারে না। চাঁদের আলোতে শিউলি বুঝতে পারেনা শফিক
কেন চুপ করে আছে । সে অনুমান করে বলে, তুমি কিছু ভাবছো মনে হয়।

খুনী মনিরের কথা তোর মনে আছে? যুদ্ধের সময় যাকে মেরে ফেলেছিল?
হ্যাঁ, কখনো ভেবে দেখেছিস তার নামের আগে খুনী কেন বলা হতো? হরিণ শিকারে গিয়ে সে নাকি কাকে খুন করেছিল।
খুনটা সে ইচ্ছা করে করেনি।

তাহলে। শোন, আমি বলি মনির নাকি বনের ভেতর লতাপাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা হরিণটিকে লক্ষ করে পরপর দু'টি গুলি ছুড়েছিল। একটি গুলি ঠিকই হরিণের গায়ে লাগে অন্যটি ঝোপের ওপাশে রাখাল ছেলেটির মাথায় গিয়ে আঘাত করে । ছেলেটি যে ওদিকে আছে সে ভাবতেও পারেনি। চিৎকার শুনে সে দৌঁড়ে দিয়ে হতভম্ব হয়ে যায়।

হাত থেকে বন্দুক ফেলে দিয়ে ছেলেটিকে কাঁধে তুলে নিয় গ্রামের দিকে দৌঁড়তে শুরু করে। ততক্ষণে রক্তের বন্যায় তার সারা শরীর ডুবে যেতে থাকে। সে যতই এগিয়ে আসে পিছু নেওয়া লোকজনের ভীড় ততই বাড়তে থাকে। কিন্তু ততক্ষণে ছেলেটি আর বেঁচে থাকতে পারে না।

তারপর! মুনিরের শাস্তি হলো । তার দশ বৎসর জেল হলো। সবচেয়ে বড় শাস্তি কি জান,
সবার কাছে সে খুনী হিসাবে পরিচিত হলো। তা ঠিক, আজো সবাই তার ছেলেমেয়েদেরও খুনী মনিরের ছেলে বলে চেনে । সেদিন একটি দুর্ঘটনার জন্য তাকে খুনী পরিচয় নিয়ে বাঁচতে হয়েছে। মৃত্যুর পরও সে নাম ঘুচেনি। কিন্তু আজ যারা দিনের বেলায় সবার সামনে খুন করে বেড়াচ্ছে তাদের কেউ নামও উচ্চারণ করতে পারছে না।

মানুষেরা এখন আগের মত নেই, কেউ কাউকে মান্য করে না। ভালো লোকেরা এখন কোন কথা বলতে চায় না। সবকিছু যেন বদলে গেছে।
সবকিছু বদলায়নি, শুধু মানুষেরা বদলে গেছে। শফিক আকাশের দিকে ইশারা করে বলে, চেয়ে দেখ তারারা এখনও ঠিক আগের মতই জ্বলছে। মনে আছে তোর গরমের দিনে রাতের বেলায় আমরা যখন হারিকেন নিয়ে এখানে পড়তে বসতাম, তখন তারা আর চাঁদ ঠিক যেভাবে আমাদের দিকে তাকাতো এখনও একইভাবে তাকিয়ে আছে।

এমন করে বললে আমার খুব খারাপ লাগে । পাগল কোথাকার? প্রকৃতির সৌন্দর্যে সবাইতো মুগ্ধ হয়। তোর কেন খারাপ লাগবে।
আমি যে শৈশব আর কৈশোরের কোন স্মৃতিই ভুলে যেতে পারিনি। এসব স্মৃতি কি কখনো ভুলা যায়।
তুমিতো ভুলে গেছ।
আমি ভুললে কি তোকে এভাবে বলতে পারতাম।
তুমি এসব মনে করে এখনো খুব আনন্দ পাও ?
তুই পাস না?
পাই, তবে আমার আনন্দের ভেতর একধরনের কষ্ট মিশে আছে।
কি রকম কষ্ট?

বলতে পার বোবা কষ্ট, যার ভাষা নেই, তাই কাউকে বুঝানো যায় না, কেবল
নিজেই এই কষ্ট অনুভব করতে পারি । শফিক নিজের অনুভবের কথাটা বলে না আর। নিঃশব্দে বসে থাকে। দীঘির জলে দৃষ্টি স্থির করে । সারা আকাশটি যেন পুকুরের তলায় চাঁদ আর তারাদের নিয়ে নেমে এসেছে। জ্যোৎস্নার সবটুকু আলো যেন পানির উপর এসে ভয় করেছে । পাড়ের গাছ-গাছালি লতা গুল্ম জড়িয়ে জল আর উদ্ভিদের মাঝে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

হঠাৎ শফিকের ইচ্ছা হয় শান্তজলে তার আর শিউলির প্রতিচ্ছবিটা দেখতে । ঠিক কি তরুলতা কিংবা অন্য প্রাণীর মত, নাকি মানুষ বলে অন্যরকম।

নীল তৃষ্ণা (এক টুকরো রোদ) - ১০নীল তৃষ্ণা (এক টুকরো রোদ) - ১০নীল তৃষ্ণা (এক টুকরো রোদ) - ১০নীল তৃষ্ণা (এক টুকরো রোদ) - ১০নীল তৃষ্ণা (এক টুকরো রোদ) - ১০নীল তৃষ্ণা (এক টুকরো রোদ) - ১০নীল তৃষ্ণা (এক টুকরো রোদ) - ১০নীল তৃষ্ণা (এক টুকরো রোদ) - ১০নীল তৃষ্ণা (এক টুকরো রোদ) - ১০নীল তৃষ্ণা (এক টুকরো রোদ) - ১০নীল তৃষ্ণা (এক টুকরো রোদ) - ১০নীল তৃষ্ণা (এক টুকরো রোদ) - ১০নীল তৃষ্ণা (এক টুকরো রোদ) - ১০নীল তৃষ্ণা (এক টুকরো রোদ) - ১০

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Ok, Go it!
close