বৃষ্টি (এক টুকরো রোদ) - ৮

Mofizur Rahman
0

বৃষ্টি (এক টুকরো রোদ) - ৮

বৃষ্টি (এক টুকরো রোদ) - ৮

বৃষ্টি

কয়েকদিন আগে ফাল্গুন শেষ হয়েছে, এখনও কোকিলের ডাক থামেনি, সু বাতাসও বয়ে যায় থেমে থেমে। ক্ষণে ক্ষণে রোদের ঝাঁঝালো রূপও বাড়তে থাকে। দুপুরে কাকের রৌদ্রস্নাত ক্লান্ত ডাক নগরীর যানজটের ভেতরও কানে আসে। আরিফের ঘুম ভাঙ্গে আজ মেঘের শব্দে। সে ভাবতে পারেনি এসময়ে মেঘ জমবে আকাশে। শুধু মেঘ নয় বৃষ্টিও নেমেছে, একেবারে বর্ষার মত আকাশ চেড়া বৃষ্টি । শুয়ে শুয়ে আরিফ বৃষ্টির শব্দ শুনে। ভোররাতে একবার ঘুম ভেঙ্গেছিল, তখন পাখিরা ডাকতে শুরু করেছে মাত্র। রাতের শেষ প্রহরের আবছা আঁধার তার মনটা ভারী করে দেয়। সহজে আর ঘুম আসে না।

এখানে আঁধারটা ওভাবে ধরা পড়ে না, পাখির ডাক তবুও ওকে সেই আলো আঁধারির মাঝে টেনে নিয়ে যায়। কিন্তু আজ পারেনি, থেমে থেমে মেঘের শব্দ ওর সব ভাবনাকে এলোমেলো করে দেয়। সে শোয়া থেকে উঠে বিছানায় বসে থাকে। পাশে সোনিয়া ঘুমে অচেতন, তার পাশে নবজাতক অর্চি মার বুকের মাঝে মুখ গুজিয়ে ঘুমাচ্ছে । আঁধারে ভেতরও আরিফ এই দু'খানি মুখ দেখতে পায় । রাতে কয়েকবার উঠতে হয় সোনিয়াকে, কোন কোন রাতে ঘুমাতে পারে না।

চোখ জুড়ে ঘুমের নেশা লেগে থাকে, তবুও জেগে থাকতে হয়। ছোট্ট বাচ্চাদের কান্নার কোন সময় নেই। তবে শেষ রাতের দিকে বিরক্ত একটু কম করে । তখন সোনিয়া ঘুমের গভীরে হেরে যায়। সারা রাতের ঘুম যেন সকালে সেরে নিতে চায়। আরিফের খুব মায়া হয় তখন আহা, বেচারী রাতে তেমন ঘুমাতে পারে না। সে সকালে বিছানা থেকে নেমে খুব সতর্ক পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজার খিল খোলে। বাচ্চা না কাঁদলে সহজে সোনিয়ার ঘুম ভাঙ্গে না এসময়ে। আরিফ দাঁতব্রাশ, শেভ, গোসল সেরে সকালের নাস্তা করে নেয়।

তারপর শান্তপায়ে অফিসের যাওয়ার জন্য রেডি হয়। তখনও সোনিয়া ঘুমে থাকে। অর্চিও। সে ঘুমের ভেতর নবজাতকের তুলতুলে গালে হাতের মৃদু পরশ লাগিয়ে বাইরে চলে যায়।
ইদানিং অর্চি বেলা পর্যন্ত ঘুমায় না। একেবারে ভোরে না, সুর্য উঠার ঘন্টা খানেক পর সে জেগে উঠে। একটু একটু হাত পা নেড়ে খেলা করে। কিছুক্ষণ পর পর হাসে। আরিফ তখন মুগ্ধ হয়নে তাকিয়ে থাকে। আজ কিন্তু সে জেগে উঠেও হাত-পা নেড়ে খেলা করছে না, হাসিও নেই মুখে, চোখ দু'টি মেলে চুপচাপ শুয়ে আছে।

সোনিয়া তখন পাশ ফিরে শোয়। আরিফ মেঘের শব্দে থেমে যায় আবার একটু ভয়ও পায়। আরিফ দেরী না করে তুলে নেয়, তারপর খাট থেকে নেমে আসে । পর্দা সরিয়ে জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়। বৃষ্টি ঝরছে অবিরাম ধারায়। গাছের পাতা আর ডাল পালায় এতদিনের জমে পড়া ধুলোবালির আস্তরণ সরে গিয়ে সজীব হয়ে উঠেছে। সবুজ পাতার মাঝে কাক পাখিরা বৃষ্টির জলে পালক ভিজিয়ে ডানা মেলে ধরেছে, তুলোর মত কোমল পালকের ভেতরে ভেতরে যেন পানির ছোঁয়া লাগতে পারে। নারিকেল গাছের নুয়ে পড়া ডাল-পাতায় পাখিরা বসতে চেয়েও পারে না। বৃষ্টি স্নাত ডালে বসে পালক মেলতে গেলে পা ফসকে যায়।

কোন কোন পাখি ডানা ঝাপটিয়ে চেষ্টা করে দেখে, পাখার মাঝে ছোট পালকে পানির পরশ নিতে। আশে পাশের দালান-কোঠার চাদে সাজানো বাগানে ফল মুল চোখে পড়ে না, কিছু কিছু বৃষ্টি স্নাত ফুল ফুটে আছে ভেজা পাতা-পল্লবের সাথে। অর্চিকে নিয়ে আরিফ যে মশারীর বাইরে গেছে তা সোনিয়া টের পায়। কিন্তু বুঝতে পারেনি জানালার পর্দা সরিয়ে বৃষ্টির দৃশ্যে বিভোর হয়ে আছে । সোনিয়া চোখ মেলে চেঁচিয়ে বলে, অর্চিকে নিয়ে ওখানে কেন দাঁড়িয়েছ? আরিফ দৃষ্টি না ফিরিয়ে বলে, ওকে বৃষ্টি দেখাচ্ছি।
আগে সেতো কখনো বৃষ্টি দেখেনি ঠান্ডা লেগে যাবে যে।
লাগবে না। আরিফ স্বাভাবিক কন্ঠে জবাব দেয়।
বাতাসের সাথে সাথে বৃষ্টির ছাট আসছে, আর তুমি বলছো ঠান্ডা লাগবে না একটু লাগলেই বা কি? জীবনের এই প্রথম বৃষ্টি, দেখার সাথে সাথে একটু শরীরেও লাগুক
সামনে বৃষ্টি দেখার ও স্পর্শ করার অনেক সময় আছে?

শিশুদের প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে বড় হতে দেয়া উচিৎ। কোনটা উচিৎ আর কোনটা অনুচিত তা পরে হবে, এখন ওকে জানালা থেকে সরাও।
তুমি এসে দেখনা, কি সুন্দর বৃষ্টি হচ্ছে। পাখিরা কেমন মনের আনন্দে গোসল করছে। সোনিয়া শোয়া থেকে উঠতে বলে, সুন্দর বৃষ্টি তুমি উপভোগ কর, আমার মেয়েকে অন্তত এদিকে দাও। উঠে দেখ, সে কেমন চোখ বড় করে বাইরে তাকিয়ে আছে।

তোমার মনে হচ্ছে যে এসব দেখনা তুমি, দৃষ্টি কেমন করে মেলে রেখেছে বৃষ্টি ভেজা পাখির দিকে। ছোটরা এমতিতেই পাখি দেখতে খুব ভালোবাসে।
তোমার ভালো লাগে না?
আমারও লাগে তবে তোমার মত না। তুমিতে একটু বেশী বেশী সব কিছুতে।
আমি? হ্যাঁ। এই যে বৃষ্টি দেখার আনন্দে ওর ঠান্ডা লেগে যাচ্ছে, সেদিকে তোমার খেয়াল নেই।

এখন যদি একটু বাতাস সইতে না পারে, সামনে ঝড় কি করে সামলাবে? সোনিয়া মশারীর ভেতর থেকে বেরিয়ে বলে, তখনতো ওর শক্তি বাড়বে, প্রতিরোধ ক্ষমতা আসবে।
বেশতো অভিজ্ঞ লোকের মত কথা বলছো আজকাল । বলবো না মা হয়েছি না? এখন কি আগের মত আছি নাকি?
অর্চিকে নিয়ে জানালার পাশে দাঁড়ানোর বিপক্ষে যুক্তি দিলেও সে নিজেও এসে দাঁড়ায়।

সন্তানকে আদরের স্পর্শ দেয় নাক টিপে দিয়ে।
আরিফ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি কিন্তু একটুও বদলাগুনি, ঠিক আগের মত আছো।
কি রকম? সোনিয়া বুঝতে না পারার মত করে জানতে চায়। বাচ্চা হওয়ার পরতো মেয়েরা অনেক বদলে যায়, শারীরিক সৌন্দর্যও অনেক কমে যায়। তুমি কি আরো কয়েকজনের ওপর গবেষণা করেছো নাকি। সোনিয়া রসিকতা করে বলে।

গবেষণা না, আশে-পাশে আত্মীয় স্বজন কতজনকে দেখছিনা। তা অবশ্য ঠিক, কিন্তু আমারও যে পরিবর্তন হয়নি তা নয় তা হয়েছে, বয়সটা একটু বেড়েছে। আগে সবাই ছোট মনে করতো।
তুমি কি যে বল বুঝি না।
অর্চি তখনও বাইরে তাকিয়ে আছে।
আরিফ স্ত্রীর দৃষ্টি টেনে বলে, তুমিতো বিশ্বাস করতে চাওনি, দেখ, কেমন স্থির নয়নে তাকিয়ে আছে।
তখন বৃষ্টির বেগ একটু কমে আসে। বাতাসটাও কেটে যায়। ভারী বর্ষণের শব্দটা ক্রমশঃ হালকা হয়ে রিমঝিম আওয়াজ তোলে। আরিফ বিভোর হয়ে পড়ে বৃষ্টিস্নাত সকালে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থেকে সোনিয়া বলে, কি ভাবছো, তোমার বৃষ্টিরাতের আরিফ সোনিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

গল্পটি।
গল্পের শেষটুকুতো এখনও বললে না ।
সব গল্পের কি শেষ আছে? কিছু কিছু গল্প আছে যা একান্ত নিজের ব্যক্তিগত,
অন্য কাউকে বলা যায় না। আমাকেও বলা যায় না!
আরিফ মাথা নেড়ে বলে, না।
বুঝি না তোমার সব কথা এখনও। বললেও বুঝতে পারবে না, তাই বলিনা।

হঠাৎ আরিফের মনটা ভারী হয়ে যায় । সে বৃষ্টির আনন্দের কাছে হেরে যায় । নবজাতক শিশুকে কোলে নিয়ে সে যে বৃষ্টির অপার আনন্দে মেতে উঠেছিল তা যেন ম্লান হতে থাকে। ধীরে ধীরে করবীর ছবিটা ভেসে উঠে। করবীর সাথে স্কুলে কখনও কথা হতো না, একই ক্লাশে পড়লেও মেয়েরা আলাদা শিফটে পাঠ নিতো। আর স্কুলেও ছেলে-মেয়েদের মেলামেশার ব্যাপারে কড়া নিষেধ ছিল।

পরিচয় থাকলেও স্কুলের আঙ্গিনায় কখনো আলাপ করা যেতো না। করবীদের দ্বিতল বাড়ির উঁচু তলায় আমরা থাকতাম। বাবা স্কুল শিক্ষক ছিলেন বলে করবীর বাবা দোতলা ভাড়া দিতে রাজী হয়েছিলেন। করবী প্রায় দিন বিকেলে আমাদের বাসায় চলে আসতো পড়া বুঝিয়ে নেয়ার জন্য । বাবা কোন ছাত্র-ছাত্রীর কাছ থেকে টাকা নিতেন না।

যেদিন বাসায় থাকতেন এমনিতেই পড়িয়ে দিতেন। শ্রেণীকক্ষে মনোযোগী হওয়ার কথা খুব করে বলতেন। করবীকে আমি তেমন পাত্তা দিতাম না, কথা বললেও এড়িয়ে চলতাম। তবুও সে যেচে কথা বলতে চাইতো আমার সাথে। বয়সের চাইতে তার শারীরিক গড়ন ছিল খুব উন্নত। পড়ার চেয়েও তার আলাপ আচরণ সবাইকে মুগ্ধ করতো । আমিও বিভোর হতাম কিন্তু কখনো বুঝতে দিতাম না, বরং উল্টোটাই করতাম।

মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ, চারিদিকে খুব গন্ডগোল । বাবা করবীর বাবাকে বললেন, আপনাদের এখানে থাকা নিরাপদ নয় ।
করবীর বাবা উল্টো প্রশ্ন করলেন, আপনাদের কি নিরাপত্তা আছে? না, আমি তা বলছি না, পাশে বিহারী পাড়া, ওখানে নাকি অস্ত্রের ট্রেনিং হচ্ছে ওরা বিভিন্ন জায়গায় হানাও দিচ্ছে।

ওপাড়ার সবাই আমাদের পরিচিত। একই এলাকায় থাকি, ওরা কি আমাদের ক্ষতি করবে?
না করলে তো ভালো। তবু চিন্তার বিষয়, কখন কি হয়ে যায় বলা মুশকিল। মাষ্টার সাহেব, বিষয়টি আমাকেও ভাবিয়ে তোলে, কিন্তু এই সময়ে কোথায় যাব এতদিনের স্মৃতি জড়ানো ঘর-বাড়ী ছেড়ে। কথাটা বলে তিনি একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলেন। বাবা আর কথা না বাড়িয়ে উপরের তলায় উঠে এলেন।

কয়েক দিন পর। সকাল থেকে ঝাঁঝালো রোদ। এদিকে আবার আকাশে ছেড়া ছেড়া মেঘ জমেছে প্রায় দিন হঠাৎ করে বৃষ্টি নামে কিন্তু আজ বৃষ্টি আসেনি । দুপুর গড়িয়ে বিকেল ছোঁয় ছোঁয়, ঠিক তখনি একটা জীপ গাড়ি দেখি বাড়ির নীচে দাড়িয়ে হরণ দিচ্ছে। আমি দৌড়ে যেতে চাইলাম, মা নিষেধ করলেন মার কথা উপেক্ষা করে আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম জীপ থেকে কয়েকজন অবাঙ্গালী লোক নামল, ওদের সবার হাতে অস্ত্র, দু'জনকে আমি চিনতে পারলাম, পাশের বিহারী কলোনীতে থাকে।

ওরা সোজা করবীদের ঘরে ঢুকে পড়লো। কয়েক মিনিটের মধ্যে পর পর দু'টি গুলির শব্দে আমরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি। বাবা বাসায় ছিলেন না। মা আমাকে টেনে বারান্দা থেকে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে নিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে কান্নার আওয়াজ কানে আসে আমি জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাই। দেখি মুখচেনা বিহারী দুইজন করবীকে টেনে হেঁছড়ে গাড়িতে তুলছে আর কয়েকজন সোনারূপার মত মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে গাড়িতে উঠছে।

করবী জানালার ফাঁকে আমাকে দেখতে পেয়ে কান্না থামিয়ে চিৎকার করে বলে উঠে, আরিফ আমাকে ওরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তুমি আমাকে বাঁচাও। মার কানেও পৌঁছে করবীর আর্তচিৎকার। মাও পর্দার আঁড়ালে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপতে লাগলেন আমিও।

জীপ গাড়িটি ট্রাট নিলো। হঠাৎ দমকা বাতাস এসে জানালার পুরো পর্দা সরিয়ে দিলো। আমি আর মা দাঁড়িয়ে রইলাম নির্বাক মূর্তি হয়ে। করবীর আর্তনাদ আরো বেড়ে যায়, গাড়ি চলতে শুরু করে। খন্ড খন্ড মেঘেরা আকাশের এককোণে জড়ো হয়ে যায় ততক্ষণে। এবার বাতাসের সাথে নেমে আসে বর্ষণের ধারায়।

একি করবীর চোখের জল, নাকি মেঘের কান্না? এখনও বুঝতে পারিনা। তবে এইটুকু বলতে পারি করবীর কান্না এখনও বৃষ্টির জল হয়ে আমাকে স্পর্শ করে যায়।

বৃষ্টি (এক টুকরো রোদ) - ৮বৃষ্টি (এক টুকরো রোদ) - ৮বৃষ্টি (এক টুকরো রোদ) - ৮বৃষ্টি (এক টুকরো রোদ) - ৮বৃষ্টি (এক টুকরো রোদ) - ৮বৃষ্টি (এক টুকরো রোদ) - ৮বৃষ্টি (এক টুকরো রোদ) - ৮বৃষ্টি (এক টুকরো রোদ) - ৮বৃষ্টি (এক টুকরো রোদ) - ৮বৃষ্টি (এক টুকরো রোদ) - ৮বৃষ্টি (এক টুকরো রোদ) - ৮বৃষ্টি (এক টুকরো রোদ) - ৮বৃষ্টি (এক টুকরো রোদ) - ৮বৃষ্টি (এক টুকরো রোদ) - ৮বৃষ্টি (এক টুকরো রোদ) - ৮বৃষ্টি (এক টুকরো রোদ) - ৮বৃষ্টি (এক টুকরো রোদ) - ৮বৃষ্টি (এক টুকরো রোদ) - ৮

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Ok, Go it!
close